বিস্মৃত এক নারী শহীদ ও দেশে দেশে ভাষা আন্দোলন

অনুপ দাশ গুপ্ত | শুক্রবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:২৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের ও মায়ের ভাষা। ১৯৫২ সালে অসংখ্য ভাষা শহীদের আত্নাহুতির বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন বর্ণমালায় লিখতে ও পড়তে পারছি। অনেক ভাষার বিলুপ্তির মতো, ভাষা আন্দোলনে অনেক শহীদের স্মৃতিও আজ বিলুপ্তির পথে। জাতি রাষ্ট্রের উত্থানের ফলে ভাষাই হয়ে উঠেছে অনেক জাতির মূল পরিচয়।
১৯৫২ সালে বাংলাদেশের মহান ভাষা আন্দোলনের ঘটনার সাথে আসামের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের বহুলাংশে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও ভারতের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দেশটির স্বাধীনতারও বহু আগের ইতিহাস। ১৯৩৭ সালে প্রথম অবিভক্ত ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তামিল ভাষা, স্বাধীনতার পর ১৯৬১ সালে আসামের শিলচরে বাংলা ভাষা, ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু ভাষা, লাটভিয়ায় রুশ ভাষা প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন হয়েছে। এছাড়া ইউরোপের বেলজিয়ামে ফ্রেন্স- জার্মান-ডাচ ভাষা, বলকান অঞ্চলে, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, আফ্রিকার গোল্ড কোষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আসামের বরাক উপত্যকায় কাছাড়া জেলার শিলচরে বাংলাভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ১১ তরুণ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন; সে ঘটনার কথা ইতিহাসে এখন ধূসর ও বিবর্ণ। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অসমিয়া নাগরিকদের মধ্যে এমন আশংকা ভর করে যে, অগ্রসরমান বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতি হয়তো একদিন অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এধরনের একটা মনস্তত্ত্বগত ভীতির কারণে আসামের শাসকেরা স্বাধীনতার পর একাধিক ভাষা-নীতিমালা প্রণয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাসে (আসাম অফিসিয়েল ল্যাঙ্গুইজ অ্যাক্ট এ-এল-এ-১৯৬০) নামে একটি অ্যাক্ট আসাম প্রাদেশিক পরিষদে পাস করিয়ে নেয়। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে বাংলা ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আন্দোলন জোরালো করার পক্ষে কাছাড়া গণসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬১ সালের ২৪ এপ্রিল সমগ্র বরাক উপত্যকায় পক্ষ কালব্যাপি পদযাত্রার কর্মসূচি শুরু করে। এই পদযাত্রায় ব্যাপক মানুষ অংশ গ্রহণ করে এবং কাছাড়া জেলার সদর শহর শিলচর থেকে শুরু করে উপত্যকার বিভিন্ন শহর ও শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চল ঘুরে আনুমানিক ২০০ মাইল পথ অতিক্রম করে ২ মে আবার শিলচরে এসে শেষ হয়। পদযাত্রা শেষে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, ১৩ মের মধ্যে যদি বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তাহলে ১৯ মে সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হবে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯ মে হরতাল শুরু হলে উত্তেজিত জনতা খুব ভোর থেকেই কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলায় সরকারি অফিস, আদালত ও রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যদিকে প্রাদেশিক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় জেলা শহর গুলোতে আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশের টহল নামায়। আনুমানিক বেলা ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে উত্তেজিত বাঙালিরা পুলিশের একটি ট্রাক আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। এ পরিস্থিতিতে তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রহরারত আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বেদম লাঠিপেটা শুরু করে এবং পূর্বঘোষণা ছাড়াই নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কমলা ভট্টাচার্য সহ ১১ বাঙালি তরুণ একের পর এক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁরা হলেন কানাই লাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদ রঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব ও কমলা ভট্টাচার্য ।
১১ জন শহীদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন একমাত্র নারী ভাষা সৈনিক। কমলা ভট্টাচার্য ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামরামান ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর ৩ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম সন্তান কমলা। কমলা ভট্টাচার্যদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের সিলেট জেলায়। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫০ সালে কমলা ও তাঁর পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে আসামের শিলচরে চলে যান। কমলা শিলচরের চোতিলাল সেন ইনস্টিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। ঘটনার আগের দিন তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়। ১৯ মে হরতাল শুরু হলে শিলচরের তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘটে যোগ দিতে সকালে যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বড় বোন প্রতিভা ধর্মঘটে যেতে নিষেধ করেন। এরপরও এই মহীয়সী নারী বড় বোনের নিষেধ উপেক্ষা করে আন্দোলনে অংশ নেন। কমলার মা সুপ্রবাসিনী দেবী কমলার এ সংগ্রামী চেতনায় খুশি হন। কমলার সঙ্গে ছোট বোন মঙ্গলাও বেরিয়ে পড়েন। অবস্থান ধর্মঘটকালে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যখন লাঠিপেটা শুরু করেন, তখন মঙ্গলা সেই লাঠির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে যান এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। ততক্ষণে চারিদিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে কমলা তাঁর বোনের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে গেলে একটি বুলেট এসে তাঁর ডান চোখ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তাতে করে কমলা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এভাবেই সেদিন বাঙালি জাতির প্রথম নারী ভাষাসৈনিক মাতৃভাষার জন্য আত্মাহুতি দেন। মহান আত্মত্যাগী এই সাহসী নারী কমলা ভট্টাচার্যকে আমরা কতজনই-বা মনে রেখেছি বা চিনি। মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার এই ঘটনার পরে আসামের শিলচরের এই রেলওয়ে স্টেশনটির নামকরণ করা হয় -‘ভাষা শহিদ স্টেশন শিলচর’।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক জাতি লড়াই করেছেন এবং আত্মাহুতি দিয়েছেন। তথ্য প্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির ভয়াল ছোবলে বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য সুবিধাজনক ভাষাগুলো দাপিয়ে বেড়ালেও মাতৃভাষার জন্য প্রাণ বলিদান, ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বিশ্বের দরবারে। দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও আমাদের দেশের বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের কিছুটা মিল আছে। কারণ দুটিতেই আন্দোলনের মূলে ছিল ছাত্ররা। পার্থক্য শুধু এতটুকুই বাংলাদেশে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আর দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল স্কুল পর্যায়ের ছাত্ররা। আফ্রিকানদের মাতৃভাষা ছিল জুলু আর লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা ইংরেজি। এই দুটি ভাষায় তাদের শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ ছিল প্রচুর। ১৯৭৬ সালে দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের সম্রাজ্যবাদী সরকার। ইউরোপীয় সম্রাজ্যবাদী ইংরেজ সরকারের ভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা, এই ভাষাটা পরিচিত ছিল আফ্রিকানস নামে। ইংরেজরা যে মাত্র আইন করে প্রাইমারী স্কুল থেকে উচ্চতর সব শিক্ষায় শ্বেতাঙ্গদের আফ্রিকানস ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হলো তখনই আফ্রিকার ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ আর ক্ষোভ জমা হতে শুরুর করলো। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন, সকালে ছাত্ররা একে একে স্কুলের সামনে জড়ো হয়। আন্দোলনের জন্য বানিয়ে নিয়ে আসা নানা কথায় লেখা প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ছিল সবার ব্যাগে। যখন ঐ দিন ১৫ থেকে ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী ভিলাকিজি স্ট্রিটে অবস্থিত অরল্যান্ডো ওয়েস্ট সেকেন্ডারি স্কুল থেকে মিছিল বের করে অরল্যান্ডো স্টেডিয়ামের কাছাকাছি যায়, তখন পুলিশ বাহিনী মিছিল ছত্রভঙ্গের চেষ্টা করে ও মিছিলে কুকুর লেলিয়ে দেয়। অনেক ছাত্র আহত হয় এবং পুলিশের নির্বিচারে গুলিতে ২০ শিশু নিহত হয় এবং আহত হয় ২০০এর বেশি। সেই মর্মান্তিক নিহত হওয়ার ঘটনা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সোয়েটো অঞ্চল (তৎকালীন জোহানেসবার্গ শহরের খুব কাছে) এবং তার পাশের শহর প্রিটোরিয়া, ডারবান ও কেপটাউনে। ১৯৭৬ সালের এই ভাষা আন্দোলনে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪৫১ জন ছাত্র মারা যায় এবং ৩,৯৭০ জন মানুষ আহত হয়।
১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে নিজের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য তামিলরা আন্দোলন করে এবং ওই আন্দোলনে প্রায় ১০০ জন তামিল নাগরিক মারা যান। ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজীকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভারতে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরিদের ভাষা আন্দোলনও রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। এছাড়াও কানাডার কুইবেক রাজ্যে ১৯৮০ সালের ২০ মে প্রথমবার এবং ১৯৯৫ সালের ৩০ অক্টোবর ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য আরবি-ফরাসি-তুর্কি কিংবা তৎকালীন মেক্সিকোর উত্তরাংশে আন্দোলন হয়েছে স্প্যানিশ-ইংরেজি নিয়ে। সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে চীনে ম্যান্ডারিন-মান্‌চুরিয়ান ভাষা প্রতিষ্ঠা নিয়েও বিরোধ হয়। রাষ্ট্র ও জনজীবনে বাংলা ভাষা অথবা বিভিন্ন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপি যে সংগ্রাম একুশে ফেব্রুয়ারী তাকে এক নতুন চেতনায় উদ্ভাসিত করেছে, যার প্রদীপ্ত আলোকছটা এখনও দেদিপ্যমান।তথ্য সূত্র:-আসামের ইতিহাস:-শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত/ ভূপেন হাজারিকা লিখিত আত্নজীবনী:-আমি এক যাযাবর (৫৬-৫৮)/ বিভিন্ন সময়ে পঠিত ইংরেজী ও বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং অন্তর্জাল।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবায়ু দূষণে বিপর্যস্ত জনজীবন
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা