‘একজন চিকিৎসক ভুল করলে একজন রোগী মারা যেতে পারে, কিন্তু একজন ফার্মাসিস্ট ভুল করলে শত–সহগ্র মানুষের প্রাণ সংহারের সম্ভাবনা রয়েছে।’ সেই মহান দায়িত্ববোধকে সামনে রেখেই ঔষধশিল্প ও স্বাস্থ্যসেবাকে এগিয়ে নেয়ার দৃঢ় সংকল্প ফার্মাসিস্টরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রতি বছর ২৫ শে সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস’ (World Pharmacists Day) পালিত হয়। ২০০৯ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত International Pharmaceutical Federation (FIP) এর কংগ্রেসে এ দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২০১০ সালে প্রথমবার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালন শুরু হয়। বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসের উদ্দেশ্য হলো হলো ফার্মাসিস্টদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তাদের অপরিহার্য ভূমিকা তুলে ধরা এবং পেশার মর্যাদা বৃদ্ধি করা। প্রতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস (World Pharmacists Day)।
যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতি বছর সারাবিশ্বে এই দিবসটি পালন করা হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার, ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স, রিসার্স প্রেজেন্টেশন হয়। ফার্মাসিস্টদের স্বাস্থ্যনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য নীতিনির্ধারকদের সাথে আলোচনা হয়। এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত, চীন, জাপানসহ বিভিন্নদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফার্মেসি শিক্ষার্থীদের জন্য আলোচনা সভা, সচেতনতামূলক র্যালি, পোস্টার প্রদর্শনী, ক্যাম্পেইন ও ক্যারিয়ার গাইডলাইন প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়। এছাড়া আফ্রিকায় গুরুত্ব দেওয়া হয় ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, ভুয়া ওষুধ প্রতিরোধ এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা প্রসারে।
বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস নানা উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশেও উদযাপিত হয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগ, বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানী, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও বিভিন্ন ফার্মেসী পেশাজীবী সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকাসহ বড় বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে উৎসাহের সঙ্গে র্যালী, আলোচনা সভা ও স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, সেমিনার ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপনা, শিক্ষার্থীদের জন্য ড্রাগ ইনফরমেশন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান ফার্মাসিস্টদের সামাজিক দায়িত্ব ও সচেতনতার জন্য ফ্রি হেলথ ক্যাম্প, ওষুধ সম্পর্কে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে থাকে।
বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে:
১. ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব ও অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। ২. স্বাস্থ্যসেবায় ওষুধের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। ৩. বিশ্বব্যাপী ফার্মেসি শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণা ও দক্ষতা উন্নয়নে উৎসাহ দেওয়া। ৪. ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প, গবেষণা, বিতরণ, হাসপাতাল ফার্মেসি ও কমিউনিটি ফার্মেসি সকল ক্ষেত্রের কর্মরত ফার্মাসিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব এবং অবদান অপরিসীম। ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি: ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। হাসপাতাল ফার্মেসি: সঠিক ড্রাগ ডোজ, ড্রাগ ইন্টার্যাকশন, ও এডভার্স ইফেক্ট ম্যানেজমেন্টে ফার্মাসিস্ট অপরিহার্য। কমিউনিটি ফার্মেসি: সাধারণ মানুষের নিরাপদ ওষুধ ব্যবহারে ফার্মাসিস্টের ভূমিকা সর্বাধিক। গবেষণা ও উন্নয়ন (জ্উ): নতুন ওষুধ আবিষ্কার ও বায়োটেকনোলজি–ভিত্তিক ওষুধ উদ্ভাবনে ফার্মাসিস্টরা অগ্রগামী।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও করণীয়: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে আরও সমৃদ্ধ ও জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ফার্মাসিস্টদের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী। বাংলাদেশে ফার্মেসি পেশাকে আরও শক্তিশালী করতে নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো জরুরি: ১.শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন: আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কারিকুলাম হালনাগাদ করা। বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি, ক্লিনিকাল ফার্মেসি বিষয়ক বিশেষায়িত কোর্স চালু করা। ২. হাসপাতাল ফার্মেসির প্রসার: প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে লাইসেন্সধারী ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা। ওষুধ ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসকের পাশাপাশি ফার্মাসিস্টদের সরাসরি সম্পৃক্ত করা। ৩. কমিউনিটি ফার্মেসি উন্নয়ন: সাাধারণ ওষুধ বিক্রেতার পরিবর্তে নিবন্ধিত ফার্মাসিস্টদের মাধ্যমে ফার্মেসি পরিচালনা করা। গ্রামীণ এলাকায় ফার্মাসিস্ট নিয়োগ ও জনসচেতনতা বাড়ানো। ৪. গবেষণা ও শিল্পখাত: নতুন ওষুধ উদ্ভাবনে গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। জেনেরিক ওষুধের পাশাপাশি ইনোভেটিভ ড্রাগ ডেভেলপমেন্টে ফার্মাসিস্টদের সম্পৃক্ত ও গুরুত্বারোপ করা। ৫. নীতি ও প্রশাসন: জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে (National Health Policy) ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা। নিয়োগ, লাইসেন্সিং ও ক্যারিয়ার পথকে আরও সুসংহত করা।
বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস শুধু উদযাপনের জন্য নয়, বরং স্মরণ করিয়ে দেয় যে ফার্মাসিস্ট ছাড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গ নয়। রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্স ও এই ত্রয়ী মিলেই রোগ প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশে ফার্মাসিস্টদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে ‘Made in Bangladesh’ ওষুধ শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে, স্বাস্থ্যসেবা আরও নিরাপদ হবে। ফার্মাসিস্টরা আজ দেশে–বিদেশে ঔষধ শিল্প ও স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন শাখায় নানা শ্রেণি বিভাগে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। ফার্মাসিস্টরা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবায়ও অবদান রাখছেন। সারা বিশ্বের কোটি হাতের সাথে হাত মিলিয়ে ফার্মাসিস্টরা সাম্য আর মানবতার প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সুখ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছেন। জয়তু ফার্মাসিস্ট।
লেখক: ফার্মাসিস্ট, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক; টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, রয়েল ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।