আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সরকারী এবং বেসরকারী পর্যায়ে এ দিবসটি পালন করা হয়। থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার, র্যালি, সিম্পোজিয়াম এবং থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য চিকিৎসা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।
এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় : “Together for Thallassemia Uniting Communities Prioritizing Patients অর্থাৎ সমাজে আমরা একসাথে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রাধান্য দিব। এক কথায় রোগীই প্রথম এবং আমরা রোগীর অবস্থা যাই হোক না কেন তা জেনে তাকে সব ধরনের সাহায্য ও সেবা দিব।
থ্যালাসেমিয়া একটি মেডিকেল সমস্যা। একটি জন্মগত রোগ। জ্বিনের ত্রুটির কারণে শরীরে রক্তে লোহিত কণিকার স্থায়িত্ব ১২০ দিনের থেকে ৬০ দিনে কমে য়ায়। ফলে রোগী ক্রমান্বয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কর্মক্ষমতা কমে যায়। শরীরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। সে সাথে মুখমন্ডলের পরিবর্তন আসতে পারে। জন্ডিস দেখা দেয়। লিভার ও প্লিহা বড় হয়ে যেতে পারে। শরীর বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অনেক সময় রক্ত এতই কমে যায় যে এ্যানিমিক হার্ট ফেইলরও হতে পারে। এছাড়া কিডনী, অগ্নাশয় ও থাইরয়েড এমনকি চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
আমাদের দেশের জন্য থ্যালাসেমিয়ার প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে রক্ত সঞ্চালন করা। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা দেখে রক্ত দিতে হয়। তবে তা হতে হবে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালন।
বাংলাদেশের সারা অঞ্চলে থ্যালাসেমিয়া রোগ বা এ রোগের বাহক জালের মত ছড়িয়ে আছে। প্রতিবছর ৫,০০০ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী বা বাহক হিসেবে জন্মগ্রহণ করছে। বিগত ২০ বছর থ্যালাসেমিয়া রোগীর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রেখেছি। এ রোগ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নোয়াখালী, কক্সবাজার এমনকি রাঙ্গামাটির পার্বত্য জেলায়ও বিস্তার লাভ করেছে।
তবে আমাদের দেশের থ্যালাসেমিয়া রোগটা অন্যান্য দেশের তুলনায় একটু ব্যতিক্রমধর্মী। এখানে বেশীরভাগ রোগী হচ্ছে বিটা থ্যালাসেমিয়া ও হিমোগ্লোবিন ই–বিটা থ্যালাসেমিয়ায় বিভক্ত। তবে অন্য একটি প্রকার আলফা থ্যালাসেমিয়াও থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রকারটি নির্ণয়ের জন্য কোন প্রযুক্তি আসে নাই। অবশ্য এই আলফা থ্যালাসেমিয়া রোগে তেমন মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায় না। তবে যদি কোন ভ্রুণে মারাত্মক আলফা থ্যালাসেমিয়া থাকে, তবে তা ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই গর্ভপাত হয়ে যায় অথবা জন্মের পর পর মৃত্যুবরণ করে।
এবার থ্যালাসেমিয়া রোগীর সেবা করতে গিয়ে কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। সম্ভবত ২০০১ সাল থেকে কেবল সেবার মন নিয়ে এই রোগের চিকিৎসা ও মান উন্নয়নে কাজ শুরু করি। থ্যালাসেমিয়া সেবা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে কাজ শুরু করলাম। কারণ এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো রোগীর অভিভাবকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অনেক চিকিৎসা ক্যাম্প করেছি। সুদূর নেদারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে বিশিষ্ট থ্যালাসেময়িা রক্তরোগ বিশেষজ্ঞরা আসেন আমাদের রোগীদের দেখতে। ঐ দেশের চিকিৎসা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। মাঝে মাঝে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করতাম। বিদেশেও অনেক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছি। নিজের পয়সা দিয়ে ঐ প্রতিষ্ঠানটিকে “থ্যালাসেমিয়া ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন” এর সদস্যপদ লাভের ব্যবস্থা করি। রোটারী ক্লাব অব চিটাগাং এর অর্থায়নে স্কুল ছাত্র–ছাত্রীদের বাহক যাচাইয়ের কর্মসূচী গ্রহণ করি। জটিল রোগের জন্য মা ও শিশু হাসপাতালের সাথে চুক্তি করে ন্যূনতম মূল্যে সেবার ব্যবস্থা করি। আমার ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এসব থ্যালাসেমিয়া রোগীর সিংহ ভাগই হচ্ছে নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত। হয়তোবা উচ্চবিত্তরা তাদের ছেলেমেয়েদের রোগটা আড়াল করার জন্য বিদেশে বা দেশের কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসা করায়।
যেহেতু থ্যালাসেমিয়া একটি দীর্ঘ মেয়াদী রোগ। ঘন ঘন রক্ত দিতে হয়। তাই এটি ব্যয় বহুল রোগ। তদুপরি কেবল রক্ত দিলেই হয় না। এই রোগের কারণে শরীরে অনেক উপাদান কমে যায়। যেমন– ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক ও ভিটামিন ডি। আবার ঘন ঘন রক্ত দেওয়ার কারণে শরীরে লৌহ বা আয়রনের পরিমান বেড়ে যায়। যা– এই রোগকে জটিল থেকে জটিলতর করতে পারে। এই বাড়তি আয়রনের জন্য একটা বিশেষ ঔষধ খেতে হয় বা ইনজেকশন পুশ করতে হয়, যা শরীর থেকে আয়রন নিস্কাশন করতে পারে। তবে এর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কাজেই এই রোগের চিকিৎসার জন্য যেমন দরকার সচেতনতা তেমন দরকার অর্থের। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজ উদ্যোগে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে ফান্ড এর ব্যবস্থা করি। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, এই সেবা কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের আর্থিক অনিয়ম দেখে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। বর্তমানে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে শিশু রোগ বিভাগে থ্যালাসেমিয়া ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে ডাক্তারী সেবা সহ সুলভমূল্যে ঔষধ সরবরাহ করা হয়।
এই বছরের বিশ্ব থ্যাল্যসেমিয়া দিবসের প্রতিপাদ্যে সমাজের থ্যালাসেমিয়া রোগীকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। রোগীর সংখ্যা বা তাদের অবস্থান যাই হোক না কেন প্রতিটি রোগীকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ প্রতিটি রোগীর রোগের ধরন, সমস্যা বা জটিলতা ভিন্ন। সমন্বিতভাবে এই রোগকে মোকাবেলা করা আমাদের মত দেশের জন্য দুস্কর হতে পারে। প্রতিটি রোগী যেন তার চ্যালেঞ্জ, তার চাহিদা ও তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
আমরা যারা স্বাস্থ্যকর্মী আছি, শুধু এই রোগকে ডায়াগনোসিস করে চিকিৎসা করলে হবে না। এ সমস্ত রোগীকে আমাদের হৃদয়ের মাঝখানে নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যনীতি ও প্র্যাকটিসের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়টি সার্থক হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগী কোনো অভিশাপে জন্ম নেয়নি। এটি একটি জন্মসূত্রে পাওয়া রোগ। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশেই বাহক যাচাইয়ের মাধ্যমে এ রোগের ব্যাপকতা কমিয়ে এনেছে।
একদা ইউরোপে বিশেষ করে গ্রিস, সাইপ্রাস, ইতালি ও স্পেনে এই রোগ মহামারী আকারে ছিল। বাহক যাচায়ের মাধ্যমে তারা আজকে রোগীর স্যংখ্যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে এনেছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যে এই রোগ এখনো বিদ্যমান। আমাদের দেশে এই রোগ সম্ভবত আরব বা মোগল ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া যেমন– থাইল্যান্ড ও মায়ানমার থেকে এসেছে। তাই এই রোগের ধরনটাও ঐ দুই জায়গার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
পরিশেষে থ্যালাসেমিয়া রোগীর মান উন্নয়নে আমাদের এই প্রচেষ্টার সাথে আপনার ও আপনার প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ও সহযোগীতা কামনা করছি। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের থ্যালাসেমিয়া ওয়ার্ডে আপনার সদয় সহানুভূতি ঐ সমস্ত গরীব অসহায় রোগীর চিকিৎসা সেবা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম।