প্রত্যেক দেশের নিজস্ব মুদ্রা রয়েছে। নিজ দেশের আর্থিক নীতি পরিচালনা করে সংশ্লিষ্ট দেশের মুদ্রার মাধ্যমে। কিন্তু কোন দেশ প্রয়োজনীয় সব পণ্যের উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ফলে জীবন বাঁচার প্রয়োজনে অথবা বিলাস পণ্য আমদানির প্রয়োজনে বিশ্বের অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। অর্থাৎ অন্য দেশ থেকে আমদানি করে নিজ দেশের চাহিদা মিটাতে হয়। কিন্তু আমদানিকৃত পণ্যের একটি নির্দিষ্ট দাম আছে। এ পণ্য আমদানির বিনিময়ে যে দাম পরিশোধ করতে হয় তা নিজ দেশের মুদ্রায় পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রার মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের দাম পরিশোধ করতে হয়। এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা কি? বলা হয়ে থাকে যে, যে মুদ্রা বা যে দেশের মুদ্রা সর্বদেশ গ্রাহ্য সেই মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বর্তমান বিশ্বে ডলার, ইউরো, পাউন্ড এ তিনটি মুদ্রা সর্বদেশ গ্রাহ্য বলে এই তিনটি মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলা হয়। ডলার মুদ্রাটি যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রবর্তিত। ইউরো মুদ্রা ইইসি (ইউরোপিয়ান ইকনোমিক কমিউনিটি) কর্তৃক প্রবর্তিত এবং পাউন্ড মুদ্রা বৃটেন কর্তৃক প্রবর্তিত। অন্য অনেক দেশের মুদ্রার নাম ডলার থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলাদেশের মুদ্রার নাম হয় টাকা। তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার নাম হয় ডলার। কিন্তু টাকা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয় না। এর জন্য প্রয়োজন ডলারের। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ডলারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন করে। অর্থাৎ কোন পণ্য আমদানি করলে তার বিল মেটায় ডলারে। আবার কোন পণ্য রপ্তানি করলে তার জন্য অর্থ পায় ডলারে। বিশ্বজুড়ে ডলারকে তাই বলা হয় ‘রিজার্ভ মুদ্রা’। বিশ্বে যত লেনদেন হয়, তার ৮৫ শতাংশ হয়ে থাকে ডলারে। IMF [INTERNATIONAL MONETARY FUND) এর তথ্য অনুসারে দেখা যায়, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর রিজার্ভের প্রায় ৬২ শতাংশই মজুত আছে ডলারে। বাকি অংশের মধ্যে ২০ শতাংশ আছে ইউরোতে। আর ৫ শতাংশ আছে জাপানের ইয়েন ও বৃটেনের পাউন্ডে।
ডলার কিভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ালো তার একটি ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কাগুজে মুদ্রা বাজারে আসে। তখন প্রধানত সেনাবাহিনীর ব্যয় মিটানোর জন্য ঐ মুদ্রা ব্যবহৃত হতো। আবার যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের একটি সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে। ডলারের চিহ্নটি হয় ৳. যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ১৭৭৬ সালে ডলারের (৳) চিহ্নটি গ্রহণ করে। ১৯১৪ সালে ব্যাংক নোট হিসেবে প্রথম ডলার ছাপানো হয়। ১৯১৩ সালে ‘ফেডারেল রিজার্ভ আইন তৈরি করে, এ আইনের ভিত্তিতে ‘ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯১৪ সাল থেকে ডলার নামক মুদ্রাটির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডলার নামক মুদ্রায় আছে ১৩ ধাপের পিরামিড, ঈগলের নখরের সংখ্যা ১৩, গ্রেট সিলের ১৩টি রেখা ও ১৩টি নক্ষত্র। ডলার কিন্তু কাগুজে নোট নয়। এখানে কাগজ ব্যবহৃত হয় না। ডলার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় তুলা আর লিলেন। ডলারে লেখা আছে একটি নীতিবাক্য। এ বাক্যটি হয় ‘ইন গড উই ট্রাষ্ট’। এ লেখাটি ১৯৬৩ সালে সংযোজন করা হয়। ডলারের আগে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল ব্রিটিশ মুদ্রা পাউন্ডের। এ মুদ্রা সমগ্র বিশ্বে ১৯২০ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছে। ডলার বাজারে আসার আগে প্রায় ৫০০ বছর ধরে যেসব মুদ্রা রাজত্ব করেছে, তার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পুর্তগাল, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের মুদ্রা। বিশ্বের নানা প্রান্তে এসব দেশের উপনিবেশ থাকায় তাদের নিজস্ব মুদ্রা বিশ্বব্যাপী রাজত্ব করেছে।
১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে বিশ্বের ৪৪টি দেশ মুদ্রা বিষয়ক সহযোগিতা সম্পর্কে আলোচনায় বসে। সেই আলোচনায় এক চুক্তির মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF ) এবং বিশ্বব্যাংক (IBRD)। উক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের ওপর ভিত্তি করে। আর ডলারের মূল্য নির্ধারিত হবে স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদেশগুলোর কাছে প্রচুর অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রি করে স্বর্ণের বিনিময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও মিত্রদের কাছে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে বিপুল স্বর্ণের বিনিময়ে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগারে ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুত করা স্বর্ণের ৭০ শতাংশ জমা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বিপুল স্বর্ণ মজুত এবং ডলারের মূল্য স্থিতিশীল থাকায় বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কারেন্সি (মুদ্রা) হিসেবে ডলার সংরক্ষণে একমত হয়। এখান থেকে সমুগ্র বিশ্বে ডলারের আধিপত্য শুরু হয়।
১৯৫০ ও ১৯৬০ এর দশকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তারা ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সোনা কিনতে থাকে। কমতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুত। এর ওপর ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যয় মেটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমান মুদ্রা (ডলার) ছাপাতে থাকে। কঠিন হয়ে পড়ে ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের ভারসাম্য বজায় রাখা। সময় গড়িয়ে আসে ১৯৭১ সাল। তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ঘোষণা করে যে, সোনার ওপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। অর্থনীতির ভাষায় ইহাকে ‘নিক্সন শক’ বলা হয়। এরপর সমগ্র বিশ্বে ডলারের গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে। বিশ্বজুড়ে ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন পলিসি গ্রহণ করতে থাকে। এর অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে এক যুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে বিশ্বের যে সব দেশ জ্বালানী তেল আমদানি করবে, তাদেরকে মূল্য পরিশোধ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে। বিনিময়ে সৌদি আরবকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে যুক্তরাষ্ট্র । এরপর মধ্যপ্রাচ্যে তেল রপ্তানিকারক দেশসমূহের সংস্থা OPEC [ORGANIZATION OF THE PETROLEUM EXPORTING COUNTRIES] কে প্রভাবিত করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালে OPEC সৌদি আরবের ন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অর্থাৎ তেল বিক্রির সব অর্থ পরিশোধ করতে হবে শুধু ডলারে। এরপরই ডলারের আধিপত্য বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দিন দিন ক্রমাগত বিশ্বব্যাপী ডলারের আধিপত্য বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ডলার নির্ভর বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে।
১৯৭১ সালে ‘নিক্সন শক’- হওয়ার কারণে মনে করা হয়েছিল যে, ডলারের আধিপত্য কমবে। পরবর্তীতে জাপানের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলে মনে করা হয়েছিল যে, ডলারের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেবে জাপানোর ইয়েন (মুদ্রা)। পরবর্তীতে ‘ইউরো’- এর কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু না। ডলারের আধিপত্যকে খর্ব করা সম্ভব হয়নি। এখন মনে করা হচ্ছে যে, চীনের মুদ্রা ইউয়ান হয়তো ডলারের আধিপত্যকে হ্রাস করতে পারবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রও ইতির মধ্যে ডলারের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য নতুন নতুন পলিসি গ্রহণ করছে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক,
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ