বিশ্বমানবতার কল্যাণে গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর (ক.) অবদান

ড. মুহম্মদ আবদুল মান্নান চৌধুরী | শুক্রবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ

স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির তথা প্রভুর সাথে মানুষের সুমধুর শান্তিময় মিলন অর্জনের জন্য এবং উভয়ের মধ্যকার পর্দা সরানোর জন্য তাঁর (স্রষ্টার) মনোনীত নবীওলীহাদীর একান্ত প্রয়োজন। বিশ্ব ত্রাণকর্তৃত্ব সম্পন্ন গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (.)-এর আগমনও ঘটেছে মানবজাতির মুক্তির জন্য, স্রষ্টার সাথে মানবের মিলন ঘটাবার জন্য। তিনি যুগোপযোগী ও চিত্তাকর্ষক কৌশল, ভাবধারা, কার্যকলাপ ও রীতিনীতি এবং চরিত্র মাধুর্য দ্বারা জাতিকে আল্লাহ্‌ তায়ালার প্রেমপথে আহ্বান করে মানবের সর্বপ্রকার মুক্তির সন্ধান দিয়ে গেছেন। তিনি নিপীড়িত ও নির্যাতিত সমগ্র মানবজাতির মুক্তির জন্য যে সকল অবদান রেখে গেছেন তার বিশেষ কয়েকটি নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করতে প্রয়াস পেলাম।

. ধর্মসাম্যের আবেদন সমৃদ্ধ তৌহিদ ও মুক্ত বেলায়তের বিকাশ: মহান প্রভুর একত্ববাদ বা তৌহিদ প্রচারই হচ্ছে ইসলামের মূল উদ্দেশ্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য এক অদ্বিতীয় মহা শক্তিমান প্রভুর একত্বজাতে সম্মিলিত হওয়া। হযরত নবী করিম (.) তাঁর আহমদী বেলায়তী শক্তি বলে মানবের ইহজগতে অবতরণের পর একমাত্র মহাপ্রভুর একত্বে মিলনের পথ আবিষ্কার করেন। মহা প্রভুর একত্বে মিলন হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ এর মূল রহস্যদ্বার। এ রহস্যদ্বারের উদ্‌ঘাটন প্রণালী খোদাতালার রহস্যজড়িত আহমদী বেলায়তী শক্তিতে নিহিত। হযরত সাহেব (.)-এর আবির্ভাবের পূর্বে ওলীগণ ধর্মীয় বিধিনিষেধের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার কারণে উক্ত রহস্যদ্বার সকল সমপ্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করতে সক্ষম হননি। হযরত সাহেব (.) সর্বপ্রথম জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল সমপ্রদায়ের জন্য উক্ত বেলায়ত উন্মোচন করতে সমর্থ হন। তাই তাঁকে স্বাধীন বাধাহীন বেলায়তের (বেলায়তে মোতলাকা) অধিপতি ও খাতেমুল বেলায়ত বলা হয়। তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট সহজতম উপায়ে আল্লাহ্‌্‌র একত্ব প্রচার করা এবং সকলকে আল্লাহ্‌্‌র একত্বে পৌঁছিয়ে দেয়ার যুগোপযোগী পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। এভাবে তিনি অবারিতভাবে খোদার তৌহিদালোক সকলের প্রতি ছড়িয়ে দেন। তিনি লোকের বাহ্যিক আচরণ ও আচার পদ্ধতিকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে আভ্যন্তরীণ ভক্তি ও স্বীকৃতিকে গুরুত্ব ও মূল্য দিতেন। খোদার একত্বে মিশতে হলে আধ্যাত্মিক প্রেরণা শক্তির সহায়তা একান্তই প্রয়োজন। এই দুর্লভ শক্তি অর্জন করতে হলে রেয়াজত ও কঠোর সাধনা অত্যাবশ্যক। এই রেয়াজত ও সাধনা দ্বারা ‘নেছবতে ছকিনা’ বা স্থায়ী খোদা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। বলা বহুল্য, বেলায়তী শক্তির ভাণ্ডার হযরত সাহেব (.) এর ইত্তেহাদী ফয়েজের দ্বারা যে কেউ স্থায়ী খোদাসম্পর্ক সৃষ্টিতে সমর্থ হতেন; কশ্‌ফ ও অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টি লাভ করতেন।

. নির্বিলাস সভ্যতার বিকাশ: হযরত সাহেব (.) আচারেব্যবহারে, আহারেবিহারে, তথা প্রত্যেক কাজের ভেতর দিয়ে নির্বিলাস সভ্যতা শিক্ষা দিয়ে গেছেন। বিলাসবহুল জীবনের আকাঙ্ক্ষা, মানুষের মধ্যে অতিচিন্তা, অতিশ্রম, অতিব্যয়, অনর্থকতা, জুলুম, অবাঞ্ছিত প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দলাদলি, ঝগড়া, কলহ প্রভৃতি অশুভ প্রবৃত্তির সৃষ্টি করে যা মানুষকে বিপথগামী করে তোলে, পারিবারিক তথা সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করে এবং জাতিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। নির্বিলাস জীবনযাপনের ফলে ধৈর্য, অল্পে তুষ্টি, সুবিচার, অন্যায় বর্জন, খোদাভীতি, খোদার উপর নির্ভরশীলতা ইত্যাদি গুণ অর্জিত হয়ে জীবন শান্তিময় হয়। হযরত সাহেব (.) অনর্থক কাজ কর্মে সময় নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। তিনি অপচয় বিরোধী ছিলেন। যাহা ব্যবহার ও ভোগ না করলে চলে এমন কোনো সামগ্রী ব্যবহারে তিনি দারুন অসন্তুষ্ট হতেন। তিনি দুনিয়াকে বলতেন ‘দারুল হাজন’ বা চিন্তাপূর্ণ দুঃখের খনি। বলা বাহুল্য, শান্তিময় জীবন যাপন ও নির্বিলাস সভ্যতা খোদা পথের সহায়ক।

. নিষ্কলুষ খোদায়ী সঙ্গীতের বিকাশ: হযরত গাউসুল আযম মাইজাভাণ্ডারী (.) এর প্রভাবে এবং তাঁর শুভদৃষ্টি ও ফয়েজ রহমত বর্ষণের ফলে এতদ্‌অঞ্চলে বাংলার গীতি জগত আল্লাহ্‌্‌, রাসূল (.) ও ওলীর প্রেম রসে সিক্ত হয়ে ওঠে। সুর সঙ্গীত বিশারদ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, সঙ্গীত বিশারদ আফতাব উদ্দিন খাঁ, রায়হান, মনমোহন, বিজয় দাস, ঈসান, রায়ভুবন, মৌলানা আব্দুল হাদী, মৌলানা বজলুল করিম, মৌলানা মোছাহেব উদ্দিন, মৌলানা আমিনুল হক হারবাঙ্গিরী, কবি আব্দুল হাকিম, কবি রমেশ শীল প্রমুখ হযরত সাহেব (.) কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে খোদাপ্রেমে গান, গজল ও নাতিয়ার পুস্তকাদি রচনা করেন। তিনি এদেশের জনগণের রুচি অনুযায়ী তাদের প্রিয় গান বাজনাকে খোদার প্রেমপ্রেরণা জাগানোর রুচিপূর্ণ কৌশল ও যুগোপযোগী জিকিরী হাতিয়ারে পরিণত করেন। গানবাজনা সহকারে খোদা প্রেমে পরিপূর্ণ গান, গজল ও নাতিয়াসহ হালকা জিকির ও অজদ পদ্ধতির প্রবর্তন হযরত সাহেব (.) এর একটি অবিস্মরণীয় অবদান।

যেহেতু এতদঅঞ্চলে লোকজন গান বাজনা কিংবা আমোদপ্রমোদ প্রিয় সেজন্য গানবাজনার মাধ্যমে হলেও কঠিন হৃদয় সম্পন্ন মানুষের হৃদয় খোদার জন্য বিগলিত করার মানসে এবং মানুষের হৃদয়ে খোদায়ী ভাবধারা জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (.) সেমা বাজনাকে জিকিরের সহায়করূপে অনুমোদন দিয়েছেন। অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে, মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকায় জিকিরের মধ্যে গানবাজনার ব্যবহার অপরিহার্য। জিকিরে গানবাজনা ব্যবহারের জন্য হযরত গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী (.) কোন তাগিদ দেননি, গানবাজনার ব্যবহারকে বাধাও দেননি, বরঞ্চ কোন কোন সময় নিজেও গান বাজনার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক গান শুনতে ভালোবাসতেন এবং কাউকে গানবাজনা সহকারে অনুষ্ঠিত জিকির মাহফিলে যোগদানের জন্য উপদেশ দিতেন। ‘আমার আমিন মিঞার দফতর খানায় গিয়ে বস’ অর্থাৎ ‘হযরত আমিনুল হক মাইজভাণ্ডারী (.) (ভ্রাতুষ্পুত্র) এর জিকির মাহফিলে গিয়ে বস’হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (.) এর মহান বাণী থেকে বুঝা যায় যে, নির্দোষ খোদায়ী ভাব সম্পন্ন গানবাজনা সহকারে জিকিরের প্রতি হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (.) এর পরোক্ষ অনুমোদন ছিল। বস্তুতঃ পক্ষে নির্দোষ খোদায়ী সঙ্গীত ইসলাম বিরোধী নয়। ঐরূপ সঙ্গীত বা গানবাজনাই ইসলাম বিরোধী হবে যা ইসলামের তৌহিদবাদ ও নীতিবোধের বিরোধী। সঙ্গীতের প্রাণ হচ্ছে সুর। সুর হচ্ছে সৌন্দর্যের প্রতীক। কুরআন তেলাওয়াত, মিলাদ শরীফ পাঠ ও সুমধুর আযানের মধ্যেও বিশেষ সুর ধ্বনিত হয়ে থাকে। বিশেষ প্রয়োজনবোধে কিংবা কোন অনুষ্ঠানের সময় হযরত রাসূলে করিম (.) গান বাজনার ভেতর দিয়ে আমোদ আহল্লাদ করতে বাধা দেননি, বরঞ্চ উৎসাহ দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ, হযরত আবু বকর (রা.) এর বাড়িতে কুমারীদের সঙ্গীত শ্রবণ (হাদিস), খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননের সময় সাহাবীদের সাথে হযরত রাসূলে করিম (.) এর সুর করে গান গাওয়া প্রভৃতি। উক্ত যুদ্ধে পরিখা খননের সময় সাহাবীদের সাথে সুর করে হযরত রাসূল করিম (.) গেয়েছিলেন:

লা খাইরা ইল্লাখাইরাল আখিরা

আল্লাহুম্মা আর হামাল আনসারা ওয়াল মুহাজিরা।’

অর্থাৎ ‘আখিরাতের শুভ ছাড়া আর কোনো শুভ নেই। হে খোদা! তুমি মুহাজির ও আনসারদেরকে রহম কর।’

অতএব, গানবাজনা সহকারে জিকিরের অনুমোদন দান হযরত গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারী (.) এর বেলায়তে ওজমার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। খোদাকে স্মরণের জন্য পাকপবিত্রতার সাথে কতিপয় শর্ত পূরণ সাপেক্ষে তিনি গানবাজনাকে অনুমোদন দিয়েছেন। মাইজভাণ্ডারী গানবাজনাকে নিয়ে যাদের মনে ভুল বুঝাবুঝি রয়েছে, আমার এই যৎসামান্য ব্যাখ্যার দ্বারা আশা করি তাদের সকল ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে।

এমনিভাবে হযরত সাহেব (.) মানবতা বিরোধী রীতিনীতি, রিপুজনিত স্বভাব ও আচরণকে ধ্বংসকারী এবং একত্ব ও উন্নত পথের সহায়ক বহু অবদান বিশ্ববাসীর সম্মুখে রেখে গেছেন যা অনন্তকাল পর্যন্ত মানব জগতে আদর্শ হিসেবে সুরক্ষিত ও কার্যকর থাকবে। ফলশ্রুতিতে মানব সমাজ যুগ যুগ ধরে খোদার নৈকট্য ও চিরশান্তি ভোগে সমর্থ হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজান্নাত লাভের অধিকারী সৌভাগ্যবানরা
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা