অবশেষে নানা জল্পনা-কল্পনার, ঝক্কি-বিতর্ক অবসান ঘটিয়ে নানা আয়োজন ও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শুরু হলো ‘গেম অব ওয়ার্ল্ড’ খ্যাত বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট ২০২২। ৩০ লাখেরও কম জনসংখ্যার ছোট এই জনপদ পুরো বিশ্বকে কিভাবে ধারণ করবে এটাই ছিল সবার কাছে বড়ো প্রশ্ন। এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসলেও শেষমেস ইতিহাসের সবচেয়ে জমকালো বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপহার দিল পুরো বিশ্বকে। আয়োজক দেশ হিসাবে কাতার সেজেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের রঙে। ২০১০ সালে বিশ্বকাপের আয়োজক হিসাবে কাতারের নাম ঘোষণা করে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা।
যার কারণে ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের দুর্লভ সম্মান অর্জন করে মধ্যপ্রাচ্যের ৩.১মিলিয়ন জনসংখ্যার ছোট এই দেশটি। ৬৪ বছর পর ফিফার মেগা ইভেন্টে নাম লিখিয়ে। ফুটবল বিশ্বকাপের ৯২ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক এই মহারণ। দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার পর ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ আসর নিয়ে ক্রীড়াপ্রেমীদের যেমন কৌতুহলের শেষ নেই ঠিক তেমনি আলোচনা-সমালোচনা ও বির্তকও থেমে নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল মানেই উম্মাদনা, যার ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে। বল পায়ে যুদ্ধ মিশনের শুরুর পূর্বে বিশ্বের ২১১টি দল থেকে বাছাইপর্ব খেলে চূড়ান্তপর্বে এসেছে বিশ্বের ৩২টি দেশ। কাতার ও ইকুয়েডরের প্রথম উদ্বোধনী ম্যাচ এর মধ্যেদিয়ে শুরু হলো বল পায়ের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সব থেকে দুর্বলতম দেশ কাতার। ফিফা র্যাঙ্কিয়ে কাতারের অবস্থান ৫০ নাম্বারে হলেও আয়োজক হিসাবে বিশ্বকাপে তারা। এবারের শিরোপা লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশের বিশ্বের সেরা তারকাদের খেলা দেখতে শুরু করেছেন বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীরা। আর এবারেই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম প্রধানদেশ প্রস্তুত করেছে বিশ্ব যুদ্ধে এই মঞ্চ।
ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে মর্যদাপূর্ণ বিশ্বকাপ ফুটবলের এ আসরে পা রেখেছে বিশ্বফুটবলের মুকুট জিততে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণকারী দলগুলো। তাই বিশ্ব ফুটবলপ্রেমীদের ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বুকেও উঠেছে ফুটবল ঝড়। আবার মাঠের ফুটবল যুদ্ধের আগে শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভক্তদের এক যুদ্ধ। জার্মানি, পর্তুগাল, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, ইতালি ও ফ্রান্সসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের খেলা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র এখন বাংলাদেশও। তদুপরি সারা বিশ্বের মতোই ফুটবল বিশ্বকাপ উন্মাদনার ছোঁয়া লেগেছে এখন চট্টগ্রামেও। কেউ পুরো বাড়ি রং করেছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের রঙে আবার গ্রামেগঞ্জেও ছেয়ে গেছে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের পতাকায়। বিভিন্ন জায়গায় চোখে পড়ে শত-অর্ধশতফুট পতাকা ঠাকানো মনোরম দৃশ্য। আবার সোসাল মিড়িয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনার ব্যতিক্রমী দৃশ্য প্রিয় দলের ডোরাকাটা সাদা-আকাশি জার্সি গায়ে ফসলী জমিতে সারিবদ্ধভাবে ধান কাটার অপরূপ দৃশ্য। যা ফুটবল ভক্তদের প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। এছাড়া শহরের বাসা বাড়ির ছাদে, দোকানে ও গাড়িতে বিভিন্ন দেশের রঙ বেরঙের পতাকা। তরুণ তরুণীদের গায়ে লেগেছে প্রিয় দলের জার্সি। আবার কোথাও কোথাও লেগেছে ব্যানার, ফেস্টুন ও দেয়ালে রং তুলির অংকনে প্রিয় তারকা খেলেওয়াদের ছবি। এ নিয়ে ভক্তদের আগ্রহের শেষ নেই। তবে এবার রাঙামাটিতে দেখা গেছে একেবারে ভিন্ন চিত্র। শহরের চারটি ব্রিজ রাঙিয়েছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের নীল-সাদা আর সবুজ-হলুদ রঙের বাহার। খুব সুন্দর এই দৃশ্য দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছেন অনেক ফুটবলপ্রেমী ভক্তরা। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছবি তুলে পোস্ট করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
আবার আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের মানুষ এখন ঝকঝকে রঙিন দুনিয়ার মতোই খেলা দেখেন ছোট বড়ো রঙিন পর্দায়। যা বাস্তবের চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। তাই এই বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তাপে বিভিন্ন জায়গায় জমে উঠেছে টেলিভিশন বিক্রির জমজমাট ব্যবসা। খেলা দেখার জন্য নতুন নতুন টিভি কিনছে মানুষেরা। কারণ সবাই মিলে বড়ো পর্দায় খেলা দেখার মজাটাই আলাদা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই উৎসাহ, উদ্দীপনা, আনন্দ, উত্তাপ ও উন্মাদনা সময়ে সময়ে বিষাদে পরিণত হয়। যেমন এই বিশ্বকাপকে ঘিরে অতিউৎসাহে কাঁচা বাঁশে আর্জেন্টিনার পতাকা লাগিয়ে টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ হারালেন খাগড়াছড়ির দীপেন ত্রিপুরা ও টাঙ্গাইলের সখীপুরে তানভীর হাসান নামে এক স্কুল ছাত্রসহ আরো একজন। যার শিরোনাম হয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। এছাড়া বাড়ির আঙ্গিনা রাস্তা বা ছাদে বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের অন্ধ সমর্থকেরা পতাকা টাঙানো নিয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে হাতাহাতি, মারামারি এমনকি ছুরিকাঘাতে হতাহতসহ ঘটেছে নানা ঘটনা। অথচ আমাদের দেশ এখনো বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার যোগ্যাতা অর্জন করতে পারেনি। কোনোদিন পারবে কিনা তা জানা নেই। খেলুক বা না খেলুক তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা বিশ্বের যেকোনো দেশের খেলাকে বা প্রিয় খেলোয়ারকে পছন্দ বা সমর্থন করতে পারি। এতে দোষের কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু প্রিয় দলের খেলা নিয়ে মারামারি, হানাহানি বা অতিরিক্ত বাড়াবাড়িই যখন ঘটে তখন নানা পর্যয়ে উঠে নানা বিপত্তি। মনে রাখা উচিত বাঙালি জাতি খুবই আবেগপ্রবণ, উৎসব ও ফুটবলপ্রিয় জাতি।
আমাদের আত্মসম্মানবোধ নিজ নিজ সম্মান, সভ্যতা, বাঙলির কৃষ্টি ও ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে একেবারেই মাতোয়ারা হওয়া অথবা এমন কিছু করা মোটেই উচিত নয় যাতে করে আমাদের ব্যক্তিসত্তা, জাতিসত্তা ও মাতৃভূমির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। অথচ আমরা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের ভিনদেশি সংস্কৃতি, দল ও দেশকে সমর্থন জানাতে কতটা সময় ও অর্থ অপচয় করছি তাকি কোনোদিন ভেবে দেখেছি? অথচ প্রতিটি বিশ্বকাপে আমাদের দেশের পাগলপারা সমর্থকেরা যে পরিমান টাকায় পতাকা, জার্সি, আলপনা, ফেষ্টুন, ব্যানার ও বাজি পোরানোসহ নানা কাজে খরচ করে তাদিয়ে দেশ ও সমাজের কাজে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয় কি?
আবার উল্লেখ্য গত বিশ্বকাপেও দুই দলের বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে সাপোটের নামে মারামারি খুনাখুনিসহ বিভিন্ন অপ্রতিকর ঘটনা যেমন সকলের নজর কেড়েছে। ঠিক তেমনি নজর কেড়েছে ভাই-ভাইয়ে, বন্ধু-বন্ধুয়ে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি মারামারি রেষারেষির মতো ঘটনা। এমন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না বা কারোর জন্য কাম্য নয়। আমরা চাই জয়-পরাজয় মানার মানসিকতা সৃষ্টি হোক সবার মাঝে। কারণ ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘এক্সেস অব এনিথিং ইজ বেড’ অর্থাৎ- অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।
কেননা পৃথিবীর ৮০০ কোটি জনসংখ্যার দেশ-বিদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এ খেলা একটি নানন্দিক খেলা ও শিল্প। এছাড়া ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল ট্রফিও অন্যান্য ট্রফির তুলনায় একটি ভিন্ন মাত্রার ট্রফি। সুতরাং বিশ্বকাপ ফুটবল উত্তাপ ও উন্মাদনায় বেসামাল না-হয়ে, শান্ত সুন্দর মনমানসিকতাকে মাথায় রেখে ছোটবড়ো ভেদাভেদ, রেষারেষি, মারামারি, একে অপরের প্রতি কটূক্তি, অপচয় ও বিভিন্ন ধরনের উসকানি পরিহার করে আসুন সংযত হয় এবং নিজ নিজ প্রিয়দল ও বিশ্বসেরা ফুটবল তারকাদের শৈল্পিক খেলা উপভোগ করি, খেলার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাশীল হয়। এটাই কামনা রইলো।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিশুসংগঠক