বিলীন হওয়ার পথে পুকুর-দিঘি-জলাশয়

গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন | বৃহস্পতিবার , ২৬ জুন, ২০২৫ at ৯:২৯ পূর্বাহ্ণ

একটা সময় ছিল যখন ধনী বিশেষ করে জমিদার, ব্যবসায়ীরা নিজের প্রতিপত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন পুকুর বা দিঘি খনন করে। এগুলোর নামকরণ হতো নিজের অথবা বংশের নামে। আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি প্রণীত চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে চট্টগ্রাম নগর ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তি বা বংশের নামে খনন করা ৩৭৬টি দিঘির কথা উল্লেখ আছে।

অপরদিকে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তাঁর চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখাবইতে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের ধনীদরিদ্র নির্বিশেষে প্রায় সব বাড়ির পেছন দিকে মেয়েদের পুকুর, সামনের দিকে পুরুষদের পুকুর, মোট দুটি করে পুকুর থাকে। বাড়ির পেছনে পুকুর না থাকলে সেকালে ভালো বৈবাহিক সম্পর্ক করা যেত না।’

চট্টগ্রাম দেশের একমাত্র স্থান যেখানে নদী, সাগর, সমভূমি, অরণ্য, ঝরণা, জলাশয় ও পাহাড়ের অপূর্ব সম্মিলনে দেশের গণ্ডি ছেড়ে পুরো বিশ্বে খেতাব পেয়েছে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে। প্রাচীন এই জনপদের মনোরম ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ বিদেশের মানুষকে এখানে বসতি স্থাপনে আকৃষ্ট করেছে। তাঁদের গড়া অনেক স্থাপনা চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় স্মারক চিহ্ন হিসেবে জীর্ণ অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চট্টগ্রামে এক সময় অসংখ্য পুকুর দিঘি, জলাশয়, ঝরণা ও প্রাকৃতিক খাল ছিল।

মোঘল আমলে এই জনপদে অসংখ্য দিঘি ও পুকুর খনন করা হয়েছিল। তন্মধ্যে মীরসরাই থানার পরাগলপুরের ছুটি খাঁ দিঘি, ফতেয়াবাদের নসরত শাহর দিঘি, হাটহাজারীর আলাওলের দিঘি, নগরের কমলদহ দিঘি, ভেলুয়ার দিঘি, কাট্টলীর মালকার দিঘি, দক্ষিণ হালিশহর হামজার দিঘি, মধ্যম হালিশহরের কলসির দিঘি, হাজি কাশেমের দিঘি, আসকার দিঘি, বদর শাহ মাজারের পাশ সংলগ্ন পুকুর, বায়েজিদ বোস্তামির দিঘি উল্লেখযোগ্য।

বিস্ময়কর হলেও সত্যি কালের সাক্ষী মোঘল আমলে খননকৃত এসব দিঘি পুকুর অধিকাংশই আর নেই। বেশ কয়েক বছর আগে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে প্রতিবছর জলাভূমির সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় জলাশয় চিহ্নিতকরণ ও শ্রেণিবিভাগ শিরোনামে এবং ভারতে পাবলিশার্স স্ট্রেঞ্জারসের জার্নাল অব দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব রিমোট সেনসিংয়ের ৪৯ নম্বর ভলিয়ুমে ‘স্পেশোটেম্পর‌্যাল চেঞ্জ অব আরবান ওয়াটার বডিস ইন বাংলাদেশ: আ কেস স্টাডি অব চিটাগাং মেট্রোপলিটন সিটি’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ ও ’১৭ সালে দুই বছরব্যাপী গবেষণা জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন দুটি তৈরি করা হয়।

বলা বাহুল্য, এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন আর সংস্কৃতির সঙ্গে এসব পুকুর, দিঘির কতটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল সে কথা নগরের পুরোনো বাসিন্দারা জানেন। ১৮৫০ সালে এক একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে চান্দগাঁওতে মাওলানা আবুল হাসান খনন করেছিলেন মৌলভী পুকুর। দেড়শ বছরের বেশি বয়সী এই পুকুর পাড়ে প্রতি বছর হতো বৈশাখী মেলা।

চান্দগাঁও এলাকার বিখ্যাত জমিদার, দানবীর ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব মরহুম হাজি চান্দমিয়া সওদাগর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য পুকুর দিঘি খনন করেছিলেন। কালের গর্ভে এই সব ঐতিহ্য এখন হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে।

চট্টগ্রামের মধ্যে লালদিঘি ও সংলগ্ন মাঠটি হলো ঐতিহাসিক। কয়েক শতক আগে লালদিঘির পাশে লালকুটি ও লালঘরের অবস্থান ছিল। এর সন্নিকটে ছিল একটি ছোট পুকুর। সম্ভবত মোঘল আমলের পরে ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে পুকুরটি সম্প্রসারণ করে দিঘিতে রুপান্তর করা হয়। ফলশ্রুতিতে লালকুটি ও লালঘরের নিকটবর্তী দিঘিটি লালদিঘিনামে খ্যাতি অর্জন করে। কিংবদন্তি আছে, তৎকালীন নামকরা জমিদার রায়বাহাদুর লালদিঘির পাড়ে বসে অবসর সময়ে আড্ডা দিতেন।

চাকমা রাজার স্মৃতি বিজড়িত আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর ভরাট হয়ে যায় ১৯৯০ সালে। এই পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন হতো পূজার সময়।নগরের নন্দনকাননের পাহাড়ে শীর্ষে ছিল প্রাচীন মন্দির, আর নিচে ছিল রথের পুকুর।সেই পুকুর থেকে শুরু হতো রথযাত্রা উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে সেখানে বসতো বিরাট মেলা। অগণিত মানুষের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠতো নিচের পুকুরপাড় থেকে পাহাড়ের চূড়ার মন্দির পর্যন্ত। বলা বাহুল্য, নন্দনকাননের তুলসীধামের নিচের পুকুরপাড় থেকে রথযাত্রা উৎসব হতো বলেই এর নামকরণ হয়েছে তুলসীধাম। পাহাড়ের উঁচুতে মন্দির আছে,কিন্তু সেই রথের পুকুর এখন আর নেই।

মোঘল আমলের অনবদ্য নিদর্শন ছিল কমলদহ দিঘি। এই দিঘির পশ্চিম পাড়ে অলি খাঁ মসজিদ, শিখ ধর্মাবলম্বীদের গুরু দুয়ারা ও কালী মন্দির। সব সম্প্রদায়ের মানুষই ব্যবহার করত এই দিঘি। কিন্তু সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠা, এই ঐতিহাসিক জলাশয়টি আজ নিশ্চিহ্ন।

লালখান বাজারে ১৩ থেকে ১৪ বছর আগেও ছিল তুলাপুকুর। চারপাশে ছিল সারি সারি তুলার গাছ। তা থেকেই এই নাম। ১৮২২ সালে ললিতা রায় নামক এই ধনাঢ্য মহিলা খনন করেছিলেন পুকুরটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ললিতার উত্তর পুরুষেরা চলে যান ভারতে। এরপরই পুকুরটি হারিয়ে যায় চিরতরে।

দেওয়ানজী পুকুর বাই লেইন নগরীর প্রসিদ্ধ এক নাম। দেওয়ানজী পুকুর সংলগ্নে এক সময় নাটক, পালাগান, কবিগানসহ নানা রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো গভীর রাত পর্যন্ত। এমনই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরা দেওয়ানজী পুকুর বাই লেন নামে আছে, কিন্তু সেই পুকুর নেই।

ঐতিহ্যবাহী হযরত শাহ আমানত শাহ (রা.) মাজার পুকুর, বলুয়ার দিঘি পুকুর, মুনশী পুকুর, রাণী দিঘি, দাম্মা পুকুরে নেই আগের জৌলুস।

প্রাচীন বৃহত্তর বাকলিয়ার আদি বাসিন্দারা বাড়ির নির্মাণের পাশাপাশি তৈরী করেছিলেন খামার বাড়িও। এসব স্থাপনার মধ্যে তারা খনন করেছিলেন পুকুর ও দিঘি। কালের বিবর্তনে সিহংভাগ পুকুর ও দিঘি ভরাট হয়েছে তাদের উত্তর পুরুষদের হাতে।

হালিশহরের একসময় জমিদারদের অসংখ্য পুকুর ও দীঘি ছিল। পুকুর সংলগ্নে এরা নান্দনিক কাঠের বাড়ি তৈরি করেছিলেন। আজ এই ঐতিহ্যগুলি যেন কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই।

দিনের পর দিন চট্টগ্রাম নগরী কংক্রিটের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। এখন শুধু দালান উঠছে চারিদিকে। একটা দালানের সঙ্গে লাগানো আরেকটি দালান। আর নব্য ধনীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আলীশান বহুতল ভবন বানাতে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে নগরের পুকুর দিঘি। বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রাচীনকালের ইতিহাসঐতিহ্যনিদর্শন আর স্মারক চিহ্ন।

আমরা কতটা নিষ্ঠুর, নিজ হাতে পূর্ব পুরুষদের গড়ে দেয়া সভ্যতাকে ধ্বংস করছি। হত্যা করছি চট্টগ্রামের অনেক কিংবদন্তি ইতিহাসের অনুষঙ্গ ও ঐতিহ্য। আর প্রাচীন নগরী চট্টগ্রামের হাজার বছরের নিদর্শনইতিহাস ঐতিহ্য ও স্থাপনা রক্ষার্থে সব মহলকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: গবেষক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেমের ম্যানুয়াল
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের সবুক্তগীন স্যার