বিরোধের মাঝে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের নয়া সংগঠনের যাত্রা

ডব্লিউটিসির কৌশল হিসেবে এই সংগঠন সৃষ্টি : আইভোয়াক আলাদা হওয়ার সংস্কৃতি আইভোয়াকের : ডব্লিউটিসি

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে জাহাজ মালিকদের মাঝে নতুন বিরোধ দেখা দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের বিরোধের জের ধরে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) ভেঙে যাওয়ার দিনকয়েকের মাঝে শুরু হয়েছে চট্টগ্রামে নতুন এই সংগঠনের যাত্রা। ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে আসা চট্টগ্রামের লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের সংগঠন ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর বেশ কিছু সদস্য ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় জাহাজ মালিক সমিতি’ নামের আলাদা একটি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করেছে। নয়া এই সংগঠনকে ঘিরেও শুরু হয়েছে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ। আইভোয়াকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নয়া এই সংগঠনের যাত্রা ডব্লিউটিসির কৌশল, অপরদিকে ডব্লিউটিসি থেকে বিষয়টি অস্বীকার করে ক্ষোভের সাথে বলা হয়েছে যে, আইভোয়াকের নেতাদের দুর্নীতির খেসারতই দেশের সাধারণ জাহাজ মালিকদের দিতে হচ্ছে।

দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে চট্টগ্রাম বন্দর। বিশ্বের নানাদেশ থেকে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য এবং শিল্পের কাঁচামালসহ অন্তত দশ কোটি টন পণ্য চট্টগ্রাম থেকে দেশের ৩৬টি নৌ রুটে পরিবাহিত হয়। বিশাল এই কর্মযজ্ঞে জড়িত অন্ততঃ আঠারশ’ লাইটারেজ জাহাজ। দেশব্যাপী পণ্য প্রবাহ ঠিকঠাক রাখার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশব্যাপী নৌ রুটে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথাক্রমে বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়ে গঠিত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) গত প্রায় ২১ বছর ধরে জাহাজ চলাচলের ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। সম্প্রতি ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সংগঠন আইভোয়াক আলাদা একটি সেল গঠন এবং জাহাজ বুকিং দেয়া শুরু করে।

দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়া নেতৃবৃন্দ পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ উত্থাপন করতে থাকে। বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকারের নৌ পরিবহন অধিদপ্তর, নৌ বাণিজ্য দপ্তর, চট্টগ্রাম চেম্বারসহ নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের সংগঠন আইভোয়াক থেকে বের হয়ে বেশ কিছু সদস্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় জাহাজ মালিক সমিতি নামের নয়া সংগঠনের মাধ্যমে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

আইভোয়াকের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নানা ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের একাংশ নয়া এই সংগঠন গঠন করেছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ৩শ’ও বেশি মালিক আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। আমরা আলাদাভাবে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করবো।

তারা বলেন, আইভোয়াকের নেতারা যখন ডব্লিউটিসির নেতৃত্বে ছিল তখন যে দুর্নীতির সূচনা হয়েছিল তা পুরো সেক্টরকেই তছনছ করে দিচ্ছে। আইভোয়াকের নেতা বাসুদেব ব্যানার্জী এবং মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কনভেনর এবং কো কনভেনর থাকাকালেই সিরিয়ালের বাইরে নিজেদের এবং নিজেদের কয়েকজন সহযোগীর জাহাজ চালানো শুরু করেছিলেন। ডেমারেজের কোটি কোটি টাকার লুটপাট করেছেন। কো কনভেনর বেলায়েত হোসেন ১৮৫টি গমবাহী জাহাজকে ছয় মাসের বেশি সময় ভাসমান গুদাম বানিয়ে রেখেছিলেন। সাধারণ জাহাজ মালিকদের নানাভাবে ঠকিয়েছিলেন। সিরিয়ালবিহীন জাহাজ চালিয়ে কোটি কোটি টাকা জরিমানার কবলে পড়েছিলেন। এসব না দেয়ার জন্য তারা ডব্লিউটিসি থেকে বের হয়ে গেছে।

কোটি কোটি টাকা লুটপাট প্রসঙ্গে ডব্লিউটিসির সাবেক কনভেনর বাসুদেব ব্যানার্জীকে একাধিকবার ফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এই ব্যাপারে ডব্লিউটিসির সাবেক কো কনভেনর মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন গতরাতে দৈনিক আজাদীকে বলেন, এসব অভিযোগ আগে কোনদিন শুনিনি। কেউ আমার সামনে এসে বলতে পারবে না। ব্যবসা করলে লেনদেন থাকবে। ডেমারেজ বকেয়া আছে। সেটা সেটেলড হলে পরিশোধ করা হবে। দোকানে বাজার করলেও কিছু বাকি থাকে। আমার কোম্পানি শত শত জাহাজ চালায়। কিছু বকেয়া থাকতেই পারে। তিনি টাকা আটকে রাখা বা না দেয়ার অভিযোগ নাকচ করে দেন।

আইভোয়াকের সদস্য একেএম শামসুজ্জামান রাসেল নয়া সংগঠনের সভাপতি এবং আইভোয়াকের সাবেক সহ সভাপতি শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ১১ সদস্য বিশিষ্ট নয়া এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগের লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের আশা ভরসার প্রতীক হয়ে উঠবো আমরা। সবধরণের অনিয়ম, একনায়কতন্ত্র এবং দুর্নীতিমুক্ত থেকে জাহাজ মালিকদের স্বার্থে কাজ করতেই নয়া এই সংগঠনের যাত্রা বলেও নয়া সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর দাবি করেন।

এ ব্যাপারে আইভোয়াকের মুখপত্র পারভেজ আহমেদ বলেন, নয়া সংগঠনের সাথে আইভোয়াকের কোনো সম্পর্ক নেই। আইভোয়াকের কোনো সদস্যই নয়া সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এই সংগঠনে এমন কিছু মানুষের নাম দেয়া হয়েছে যারা নিজেরাও নয়া সংগঠনের কথা জানেন না। এটি ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) সৃষ্টি বলে মন্তব্য করে পারভেজ আহমেদ বলেন, বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিশেষ কৌশল হিসেবে ডব্লিউটিসি নয়া এই সংগঠনের সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন জাহাজ মালিকেরা। এই ধরণের সংগঠন সৃষ্টি করে ডব্লিউটিসির দুর্নীতি চাপা দেয়া যাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এই ব্যাপারে ডব্লিউটিসির কনভেনর মোহাম্মদ নুরুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া সংগঠন সৃষ্টির সাথে ডব্লিউটিসির কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান। তিনি বলেন, আলাদা হয়ে নয়া সেল গঠনের সংস্কৃতি আইভোয়াকের রয়েছে, ডব্লিউটিসির নয়।

আজ বৃহস্পতিবার থেকে চট্টগ্রামের নৌ বাণিজ্য দপ্তর থেকে একই সিরিয়ালে লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের কথা রয়েছে। নয়া সংগঠনের যাত্রা সরকারের এই নির্দেশনায় কোন প্রভাব ফেলবে না বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের নয়া সংগঠনের সাথে সরকারি নির্দেশনার কোনো বিরোধ নেই। নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ আজ থেকে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) পূর্বানুমতি নিয়ে একই সিরিয়ালে জাহাজ পরিচালনার ব্যাপারে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কোস্টগার্ডের টহল জোরদার
পরবর্তী নিবন্ধএএফসি হেলথের সাত পরিচালকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা