বোয়ালখালী উপজেলার আকুবদন্ডী ২ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী দেলোয়ার হোসেন সওদাগর বাড়ির মো. নুরুল আবছার (৫৫) ও রুবি আখতার (৪৪) দম্পতির ছেলে ওমর বিন নূরুল আবছার (২৪)। পড়ালেখা, কষ্ট, পরিশ্রম সবই করে এগোচ্ছিল জীবনের লক্ষ্যে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, স্বপ্ন পূরণের ঠিক আগ মুহূর্তেই ওমর চলে গেল চিরতরে। গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিল থেকে ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টার (বিএটিসি) এর মেধাবী ছাত্র ছিলেন ওমর। ছয় ভাই বোনের মধ্যে ওমর তৃতীয়। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর ঢাকার উত্তরায় আনন্দ মিছিল শেষে বাসায় ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ওমর। ওমরের এমন চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না পরিবার ও সহপাঠীরা।
ওমরের স্বপ্ন ছিল বিমান প্রকৌশলী হবেন। তার মা–বাবাও এই স্বপ্নের পথে হাঁটতে ছেলেকে সাধ্যমত সহায়তা করেছেন। স্বপ্ন পূরণে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েও ওমরের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেলো। ঢাকার সাভারের উত্তরা সেক্টর ১৪/১৮ নাম্বার রোডে বন্ধুদের সাথে ভাড়া বাসায় থাকতেন ওমর। সেখান থেকে বিএটিসিতে পড়াশুনা করছিলেন। তিন বছরের কোর্সের ১৩টি মডিউলের ১২টি মডিউল শেষ করেছিলেন ওমর। এরই মধ্যে পেয়েছিলেন ইউএস–বাংলা এয়ারলাইন্সে কাজ করার সুযোগও। ছোট বেলা থেকেই নানামুখী আবিষ্কারের প্রতিভা ছিল তার। কিন্তু ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়েছে সবার স্বপ্ন।
ওমরের শোকস্তব্ধ মা রুবি আখতার বলেন, ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরও কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে মনে বারবার বলছিলাম, সংবাদটি যেন মিথ্যা হয়। কিন্তু পরক্ষণেই সবকিছু ওলটপালট করে দেয় আমার ছেলের মৃতদেহ। যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। আজ সবকিছুই শেষ হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তার বাবা নূরুল আবছার দেশে ফিরে আসেন। তিনি ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেছেন। কোনোভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না। যে কয়দিন দেশে ছিলেন ছেলের তৈরি করা বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখে কান্না করতেন। ওমরের বাবা জীবনের বেশিরভাগ সময় প্রবাসে কাটিয়েছেন। খেয়ে না খেয়ে, নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সন্তানদের মানুষ করার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ঘাতক বুলেট আমাদের সে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। আমার ছেলে এ দেশের সম্পদ। এ সম্পদকে যারা চিরতরে শেষ করে দিয়েছে আমি তাদের বিচার চাই। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় সে বিচার দেখে যেতে চাই।
ওমরের চাচাতো ভাই ইঞ্জিনিয়ার আবু বক্কর রাহাত বলেন, মিছিল থেকে ফেরার পথে সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরা থানা এলাকায় পুলিশ গুলি করলে সে মারা যায়। মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) ভোর ৪টায় লাশবাহী গাড়ি করে ওমরের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। গ্রামের মানুষ তার এভাবে চলে যাওয়ায় ভীষণ শোকাহত।
ওমরের ছোট ভাই আম্মার বিন নূরুল আবছার (১৯) বলেন, আমার ভাইতো কোনো দোষ করেনি। কেন আমার ভাইকে পুলিশ গুলি করলো? আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।
মৃত্যুর প্রায় ১০ মাস ২০ দিন পর আদালতের নির্দেশে বুধবার (২৫ জুন) সকাল ১০টায় নিহত ইঞ্জিনিয়ার মো. ওমরের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। দেশের পারিপার্শ্বিক কারণে ভিকটিমের অভিভাবকরা সুরতহাল, ময়নাতদন্ত এবং স্থানীয় পুলিশকে অবগত না করে ওমরের লাশ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট উপজেলার আকুবদণ্ডী গ্রামের কবরস্থানে দাফন করেন। ফলে ভিকটিমের সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে চলতি বছরের গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট লাশ উত্তোলনের আদেশ দেন।
এ বিষয়ে এঙিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কানিজ ফাতেমা বলেন, আদালতের নির্দেশে শহীদ ওমরের মরদেহ উত্তোলনের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এরপর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পুনরায় দাফন করা হয়েছে। মরদেহ উত্তোলনের সময় নিহত ওমরের মা ও পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।