চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে নগরের দুই নম্বর গেইট–এ একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। একইভাবে চলতি বছরের ফ্রেব্রুয়ারিতে জিইসি মোড়ে আরেকটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর দীর্ঘদিন পার হলেও ফুটওভার ব্রিজ দুটির কাজ শেষ হয়নি। এর কারণ হিসেবে চসিকের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, কাজ শুরুর পর ওয়াসা, পিডিবিসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার পাইপলাইন সরানোর জটিলতার কারণে কাজ থমকে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর সড়কে আরেকটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু করতে যাচ্ছে চসিক। সড়কটির ১৫ নম্বর গুপ্তখালের অদূরে বিআরআরবি’র পাশে এ ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। আজ সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার কথা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ফুটওভার ব্রিজটি হবে স্টিলের। এর দৈর্ঘ্য হবে ২০ থেকে ২১ মিটার। ফুটওভার ব্রিজটিতে ওঠানামার জন্য চারটি সিঁড়ি থাকবে নৌ–বাহিনীর অনুরোধে এ ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। এতে ব্যয় হবে দেড় কোটি টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘নারায়নগঞ্জ ড্রাইডক’কে এ জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়। চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বিমানবন্দর সড়কটি চার লেইনের। এ সড়কে ট্রাক–লরিসহ অন্যান্য দ্রুত যানবাহনগুলো চলাচল করে। ওখানে একপাশে বিএনআরআরবি এবং আরেকপাশে বিএনআরআরবি মেস কোয়ার্টার। ওখানে কোস্টগার্ডের অফিসও আছে। প্রতিদিন ওখানে কয়েক শ নেভীর কর্মকর্তা রাস্তা পারাপার করেন। গত দুই বছরে এখানে দুর্ঘটনায় কয়েকজন মারা যান। তাই ফুটওভার ব্রিজটি হলে রাস্তা পারাপার সহজ হবে এবং দুর্ঘটনাও রোধ হবে।
জিইসি মোড় ও ২ নম্বর গেইট ফুটওভার ব্রিজ সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলোর কাজ দ্রুত শুরু হবে। আসলে ৫ আগস্টের পর নানা কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি ছিল। যা মেয়র মহোদয় যোগ দেয়ার পর বেড়েছে। ওখানে ইউটিলিটি নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। ইউটিলিটি শিপটটিং নিয়ে পিডিবি’র সাথে বার বার কথা বলেছি। আশা করি সমাধান হবে এবং কাজ শুরু হবে। ২ নম্বর গেইট ফুটওভার ব্রিজের ডিজাইন চূড়ান্ত হয়েছে। ওখানে ইউটিলিটি শিফটিং নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। যার সার্ভে করার জন্য স্ব স্ব নির্বাহী প্রকৌশলীদের প্রাক্কলন উপস্থাপনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
এ কর্মকর্তা বলেন, আমরা সকল ফুটওভার ব্রিজের ডিজাইন–ড্রয়িং সম্পন্ন করেছি। কিন্তু ফুটওভার ব্রিজের একটি সমস্যা রয়েছে। কাজ শুরু করলে দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। কোথাও ইলেক্ট্রিক পোল, আবার কোথাও পানি বা গ্যাস লাইন থাকে। কিন্তু এসব সরানোর জন্য বরাদ্দ প্রাক্কলনে না থাকায় জটিলতা তৈরি হয়। তাই এসব সমস্যা আগেভাগে চিহ্নিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীদের ডিজাইন–ড্রইং দেয়া হয়েছে। যাতে তারা সার্ভে করে প্রকৃত প্রাক্কলন করতে পারেন। আশা করছি দ্রুত দরপত্র আহ্বান করা যাবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, জিইসি, ২ নম্বর গেইট এবং বিআরআরবি ফুটওভার ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হবে ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায়। প্রকল্পের আওতায় মোট ৩৮টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করবে চসিক। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮ কোটি টাকা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, জিইসি, ২নং গেইট, ষোলশহর দুই ফ্লাইওভারের মাঝখানে, পুরাতন চান্দগাঁও থানা এলাকা, ইডিজেড, কাঠগড়সহ পৃথক ৮ মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের কে–ইপিজেড এর সামনে এবং চান্দগাঁও–এ একটির কাজ শেষ হয়েছে। ফিনিশিং কাজ বাকি আছে। শীঘ্রই এ দুটোর উদ্বোধন করা হবে বলে আজাদীকে জানান চসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুল ইসলাম।
জানা গেছে, নগরের বিভিন্ন সড়কে প্রতিদিন আনুমানিক কয়েক লক্ষ মোটরযান ও রিকশা চলাচল করে। ফলে সবসময় ব্যস্ত থাকে সড়কগুলো। বিপুল সংখ্যক যানবাহনের চাপে রাস্তা পার হতে বেগ পেতে হয় পথচারীদের। অথচ নগরে ফুটওভার বর্তমানে ফুটওভার ব্রিজ আছে মাত্র ৬টি। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি চসিকের উদ্যোগে জাকির হোসেন রোডের ওয়ার্লেস মোড়ে স্কেলেটরসহ নির্মিত ফুটওভার ব্রিজ উদ্বোধন করা হয়। তবে উদ্বোধনেরর মাস দেড়েক পর থেকে সেটি আর ব্যবহার হয়নি।
এদিকে গত সপ্তাহে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রাম নগর সড়ক নিরাপত্তা প্রতিবেদন ২০২১–২০২৩’ অনুযায়ী, নগরে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটছে পথচারীদের। শহরে গত সাত বছরে ৬৮৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৬৯ জন। এর মধ্যে ৩১৩ জনই পথচারী। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাত বছরে নগরে সড়ক দুুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন ১ হাজার ২৮ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ৭২ জনের। ২০২৩ সালে মারা যান ৯৬ জন।
এছাড়া গত বছর (২০২৩) প্রকাশিত ‘ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটি‘র (বিআইজিআরএস) একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়াদের ৫৬ শতাংশই পথচারী। রাস্তা পার হতে গিয়েই বেশিরভাগ সময় দুর্ঘটনার শিকার হন বলে জানা গেছে। যারা ফুটওভার ব্রিজ থাকলে নিরাপদে সড়ক পার হতে পারত। ফলে নগরে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নগরের ১০টি মোড়ে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে সিএমপি থেকে চসিক প্রশাসককে প্রস্তাব দেয়া হয়। মোড়গুলো হচ্ছে– নিউমার্কেট মোড়, বাদামতল মোড়, জিইসি মোড়, দেওয়ানহাট মোড়, টাইগারপাস মোড়, ইস্পাহানি মোড়, ষোলশহর ২সং গেইট, ওয়াসা মোড়, চৌমুহনী মোড় ও কর্নেলহাট মোড়।
বিভিন্ন সময়ে নগরের পুরাতন চান্দগাঁও থানা মোড় এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণে দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সল্টগোলা রেল ক্রসিংয়ে পদচারী সেতু নির্র্মাণে ২০১৯ সালে ‘বৃহত্তর হালিশহর ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে মানববন্ধন করা হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ‘নগর ও নাগরিক’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে লালখান বাজার মোড়সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। সংগঠনটি ওই সময় সিটি মেয়রকে স্মারকলিপিও দেন একই দাবিতে।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে ‘জাবালে নূর’ পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। আহত হন আরো ১৫ শিক্ষার্থী। ঘটনার পর ‘নিরাপদ সড়ক’র দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনে নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ওই সময় চট্টগ্রামেও আন্দোলনকারীরা ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবি করেন।