‘প্রকৃতির নিরাবরণ মুক্ত রূপের স্পর্শে অনুভূতি খোলে। সুপ্ত আত্মা জাগ্রত হয় চৈত্র দুপুরের অলস নিমফুলের গন্ধে। জ্যোৎস্না ভরা মাঠে, আকন্দ ফুলের বনে, পাখীর বেলা–যাওয়া উদাস গানে, মাঠের দূর পারে সূর্যাস্তের ছবিতে, ঝরা পাতার রাশির সোঁদা সোঁদা শুকনা শুকনা সুবাসে। প্রকৃতি তাই আমার বড় বিশল্যকরণী মৃত, মূর্ছিত চেতনাকে জাগ্রত করতে অত বড় ঔষধ আর নাই।’–আত্মোপলব্ধিতে বিভূতিভূষণ।
নিজেকে নিয়ে এমন পরিণত ভাবনা বিভূতিভূষণের ‘তৃণাঙ্কুর‘ দিনলিপিতে। সত্যিই প্রকৃতি তাঁর বড় বিশল্যকরণী। এরচেয়ে বড় কিছু আর কী হতে পারে! প্রকৃতিকে ভালোবেসে, মন ও মননে ধারণ করে সাহিত্যের উপজীব্য করে যিনি তুলে ধরতে পারেন, তিনিই সত্যিকারের প্রকৃতিপ্রেমী।
বিভূতিভূষণের এই এক মহা সংযোজন বাংলা সাহিত্যে, প্রকৃতি ও আপন মনস্তত্ত্বকে মিলিয়ে মিশিয়ে যে অনবদ্য সাহিত্যরূপ তিনি তৈরী করেছেন– বাঙালি পাঠক যুগ যুগ ধরে চাইলেও এই মুগ্ধতার ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারবে না।
বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতির বিশাল পটভূমিকে উপজীব্য করে তাতে নান্দনিকতার মিশেলে নিসর্গ, আর গ্রাম্য জীবনকে কেউ যদি সবচেয়ে নিখুঁতভাবে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলে আনেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
চরিত্রের উপস্থাপন, অতুলনীয় গদ্য আর দৈনন্দিন জীবনকে বাস্তবসম্মতভাবে সাহিত্যে তুলে আনা থেকে ভাষার অপরূপ উপস্থাপন; সবকিছু মিলিয়ে তাঁর লেখা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রকৃতির জীবন শিল্পী। বাংলা কথা সাহিত্যের ব্যাপ্তিতে যার তুলনা পাওয়া ভার।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ সংবেদনশীল পাঠক মাত্রেই জানেন। আজকের দিনেও, প্রায় এক শতাব্দী কেটে যাওয়ার পরেও বিভূতিভূষণের এই চেতনা এখনো সমান প্রাসঙ্গিক।
বিভূতিভূষণের পৃথিবীর সঙ্গে বর্তমান জগতের বিস্তর অমিল। শতাব্দী পিছিয়ে দেখতে হবে না, প্রযুক্তিকেন্দ্রিক প্রগতির জেরে আমাদেরই ছোটবেলার পৃথিবীর সঙ্গে এই পৃথিবী আর মেলে না। কিন্তু বিভূতিভূষণের প্রকৃতি চেতনার বা প্রকৃতির প্রতি তার একান্ত মমত্ববোধ এখনো পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করে। প্রকৃতি মানবজীবনের সাথে অতি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে জড়িয়ে আছে সৃষ্টির আদি থেকেই। বিভূতিভূষণের প্রতিটি সাহিত্যকর্ম তারই উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘জগতের অসংখ্য আনন্দের ভাণ্ডার উন্মুক্ত আছে। গাছপালা, ফুল, পাখী, উদার মাঠঘাট, সময়, নক্ষত্র, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না রাত্রি, অস্ত সূর্য্যের আলোয় রাঙা নদীতীর, অন্ধকার নক্ষত্রময় উদার শূন্যৃ এসব জিনিস থেকে এমন সব বিপুল, অবক্তব্য আনন্দ, অনন্তের উদার মহিমা প্রাণে আসতে পারে, সহস্র বৎসর ধরে তুচ্ছ জাগতিক বস্তু নিয়ে মত্ত থাকলেও সে বিরাট অসীম, শান্ত উল্লাসের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই কোন জ্ঞান পৌঁছয় না। সাহিত্যিকদের কাজ হচ্ছে এই আনন্দের বার্ত্তা সাধারণের প্রাণে পৌঁছে দেওয়া তাদের অস্তিত্বের এই শুধু সার্থকতা।’
প্রকৃতিকে আপন করে নেয়া এই সাহিত্যিক সত্যিই প্রকৃতিপ্রেমের অনন্য নিদর্শন রেখে গেলেন তাঁর সাহিত্যে। ‘পথের পাঁচালী’ জীবনের সমস্ত হাসি– আনন্দ, ক্ষুধা বঞ্চনার, দারিদ্র্যের মর্মস্পর্শী চালচিত্র এক লহমায় তুলে এনেছেন একটি মলাটের মধ্যে। সাথে তুলে এনেছেন প্রকৃতিকে। যার অবারিত, উদার পটভূমিতে এই উপন্যাসের অপু দুর্গা জীবনধারণের রসদ পায়। যেখানে সাদা কাশের বনে, আকাশের নীলের সাথে তাদের দৃষ্টি বিনিময় হয়। যেখানে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ, মাঠের পরে লম্বা রেলপথ, যেখানে দুর্গাপূজা, চড়কের মেলা ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কী নেই এই উপন্যাসে। নিশ্চিন্দিপুরের এই পাড়াগাঁয়ে রচিত হয়ে গেলো জীবনের ধ্রুবসত্যের এক মহা দলিল। কী অসাধারণ পরিমিতিবোধ, স্বর্গীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ, কাহিনি, চরিত্র, দুঃখের অনন্ত অসাধারণ মহিমা এক চিত্রপটে তুলে ধরা এক ছবির মতো পাঠকের সামনে উঠে এলো। যেখানে পাঠক অপু দুর্গার খুশিতে আত্মহারা, আবার দুর্গার করুণ মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান। মোটকথা, উপন্যাসকে জীবনের অংশ করে তুলতে উপন্যাসিকের অসাধারণ ক্ষমতা প্রশংসার দাবীদার। সেখানে প্রকৃতিকে মূল কাহিনির সাথে জুড়ে দিতে বিভূতিভূষণের জুড়ি নেই। “মানুষের বসতির পাশে কোথাও নিবিড় অরণ্য নাই। অরণ্য আছে দূরদেশে, যেখানে পতিত— পক্ব জম্বফুলের গন্ধে গোদাবরী তীরের বাতাস ভারাক্রান্ত হইয়া ওঠে।
‘আরণ্যক’সেই কল্পলোকের বিবরণ। ইহা ভ্রমণবৃত্তান্ত বা ডায়েরী নহে–উপন্যাস।”– আরণ্যকের শুরুটা ঠিক এমন। বইয়ের প্রথমদিকটাতে তিনি মনের অবস্থা ব্যক্ত করেছেন এভাবেই–
‘কলিকাতা শহরের হৈ–চৈ কর্মকোলাহলের মধ্যে অহরহ ডুবিয়া থাকিয়া এখন যখন লবটুলিয়া বইহার কি আজমাবাদের সে অরণ্য–ভূভাগ, সে জ্যোৎস্না, সে তিমিরময়ী স্তব্ধ রাত্রি, ধু–ধু ঝাউবন আর কাশবনের চর, দিগ্বলয়লীন ধূসর শৈলশ্রেণী, গভীর রাত্রে বন্য নীল–গাইয়ের দলের দ্রুত পদধ্বনি, খররৌদ্র–মধ্যাহ্নে সরস্বতী কুণ্ডীর জলের ধারে পিপাসার্তবন্য মহিষ, সে অপূর্ব মুক্ত শিলাস্তৃত প্রান্তরে রঙীন বনফুলের শোভা, ফুটন্ত রক্তপলাশের ঘন অরণ্যের কথা ভাবি, তখন মনে হয় বুঝি কোন অবসর–দিনের শেষে সন্ধ্যায় ঘুমের ঘোরে এক সৌন্দর্যভরা জগতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, পৃথিবীতে তেমন দেশ যেন কোথাও নাই। শুধু বনপ্রান্তর নয়, কত ধরনের মানুষ দেখিয়াছিলাম।’ প্রকৃতি যার কাছে সতত সুন্দর, সত্য, অপরূপ হয়ে ধরা দিয়েছে, তিনিই প্রকৃতির ধ্বংসের আগাম সতর্কতাও জানিয়েছিলেন। লাগামহীন সভ্যতার আগ্রাসী ভূমিকাকে সফল করতে মানুষের যে নির্বিবাদে প্রকৃতিকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা, তাতে তিনি বিষণ্ন হয়েছেন। বিভূতিভূষণের ভাষায় এই গভীর বিষণ্নতা পাঠককে ছুঁয়ে যায়।
‘নাঢ়া–বইহার ও লবটুলিয়ার সমুদয় জঙ্গলমহাল বন্দোবস্ত হইয়া গিয়াছে। এখন আর কোথাও পূর্বের মতো বন নাই। প্রকৃতি কত বৎসর ধরিয়া নির্জনে নিভৃতে যে কুঞ্জ রচনা করিয়া রাখিয়াছিল, কত কেঁয়োঝাঁকার নিভৃত লতাবিতান, কত স্বপ্নভূমি জনমজুরেরা নির্মম হাতে সব কাটিয়া উড়াইয়া দিল, যাহা গড়িয়া উঠিয়াছিল পঞ্চাশ বৎসরে, তাহা গেল এক দিনে। এখন কোথাও আর সে রহস্যময় দূরবিসর্পী প্রান্তর নাই, জ্যোৎস্নালোকিত রাত্রিতে যেখানে মায়াপরীরা নামিত, মহিষের দেবতা দয়ালু টাঁড়বারো হাত তুলিয়া দাঁড়াইয়া বন্য মহিষদলকে ধ্বংস হইতে রক্ষা করিত।’
‘নাড়া–বইহার নাম ঘুচিয়া গিয়াছে, লবটুলিয়া এখন একটি বস্তি মাত্র। যে দিকে চোখ যায়, শুধু চালে চালে লাগানো অপকৃষ্ট খোলার ঘর। কোথাও বা কাশের ঘর। ঘন ঘিঞ্জি বসতি টোলায় টোলায় ভাগ করা ফাঁকা জায়গায় শুধুই ফসলের ক্ষেত। এতটুকু ক্ষেতের চারিদিকে ফনিমনসার বেড়া। ধরণীর মুক্তরূপ ইহারা কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া নষ্ট করিয়া দিয়াছে।’
আবার কিছু পরে লেখক বলছেন, আমাদের যুগের পূর্বানুমানে– ‘এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবে না শুধুই চাষের ক্ষেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে, তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্যপ্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে। সেই সব অনাগত দিনের মানুষদের জন্য এ বন অক্ষুণ্ন থাকুক।’
‘স্মৃতির রেখা’ দিনলিপি বিভূতিভূষণের এই সময়কার রচনা, ভাগলপুরের কাছারিতে বসে লেখা। সেখানে তিনি লিখেছেন,
‘আজ বসে বসে অনাগত দূর ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়ছে আমার সেই সব অনাগত শিশু প্রপৌত্র, বৃদ্ধ–প্রপৌত্র ও অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্রদের জন্যে কি রেখে যাব তাই ভাবছি।’ আর এক জায়গায় লিখেছেন: ‘একশত বৎসর পরে আমার নাম দশ বৎসর আগেকার পাতা মাকড়সার জালের মত কোথায় কালসাগরে মিলিয়ে যাবে তবে কি রেখে যাবো আমার দুঃখের মত দুঃখী ঐ সব অনাগত কচি কচি শিশু মনগুলির খোরাকের জন্যে? কি রেখে যাবো? কি সম্পত্তি, কি heritage তাদের জন্যে দেবো?’
বিভূতিভূষণ শতবছর আগেই ভেবেছেন আমাদের প্রজন্মের জন্য। এই যান্ত্রিক কলুষিত পরিবেশে, অনাগত ভবিষ্যতের জন্য আমরা সত্যিকার অর্থে কী রেখে যাবো? কেমন প্রকৃতি তাদের মনের খোরাক যোগাবে এ নিয়ে তাঁর দূরদর্শিতা পাঠকমনে তাঁর জন্য আরও একটি নতুনতর মাত্রা যোগ করবে নিঃসন্দেহে। নির্বিবাদে পাহাড় থেকে সমতল, নদী থেকে সমুদ্র দূষিত হচ্ছে প্রতিদিন। প্রকৃতির সেই নির্মলতা, সৌন্দর্য, শান্ত স্নিগ্ধ রূপের পসরা এখন আর নেই কোথাও। প্রত্যেক জায়গায় হিংস্র নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত প্রকৃতিমাতা। তাঁর সে ক্ষত সারানোর দায় নেই কারোর। বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেম বর্তমান প্রজন্ম তথা বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
লেখক: প্রাবন্ধিক।