দীর্ঘ ৩৫ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হয় এ ভোটগ্রহণ। বিকেল ৪টার পর আর কাউকে নতুন করে কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। তবে কেন্দ্রের ভেতরে যারা লাইনে ছিলেন তারা চারটার পরও ভোট দিতে পেরেছেন। নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ক্যাম্পাসে ছিল উৎসবের আমেজ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ভোট গ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন প্যানেল ও প্রার্থীদের কেউ কেউ অভিযোগও করেন।
ভোট বর্জন করবে না ছাত্রদল : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (চাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরলেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বলছে, তারা ভোট বর্জন করবে না। ভোট শেষের ঘণ্টা তিনেক পর বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন সংগঠনটির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখার নেতারা। তাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেছে। অভিযোগ জানানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বরং দেখছি বলেই দায় এড়িয়ে গেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার আশ্বস্ত করেছিলেন ডাকসু ও জাকসু থেকে শিক্ষা নিয়ে চাকসুর নির্বাচন অনন্য উদাহরণ তৈরি করবে। কিন্তু আমরা দেখলাম প্রতিটি পদে পদে অনিয়ম কারচুপি ঘটেছে। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশনার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বিকার ছিল।
নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের ১০০ গজের মধ্যে প্রার্থী বা সংগঠনের প্রচার চালানোর সুযোগ না থাকার কথা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিকের অভিযোগ, একাধিক কেন্দ্রে নির্দিষ্ট প্রার্থীরা ভোটের সময়েও প্রচারণা চালিয়েছেন এবং ভোটারদের হাতে ভোটের স্লিপ বিতরণ করেছেন। যেখানে নির্বাচন কমিশনের লোকজন উপস্থিত ছিল, তাদের চোখের সামনেই এমন অনিয়ম ঘটেছে। অথচ কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে অভিযোগ ওঠে, ভোট দেওয়ার পর ব্যবহৃত কালির দাগ অনেক ভোটারের হাতে মুছে গেছে। ফলে একাধিকবার ভোট দেওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেন তিনি।
রাত পর্যন্ত ভোট গণনা চললেও ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী তৌফিক বলেন, তারা ফলাফল মেনে নাও নিতে পারেন। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার নিয়ে নির্বাচন করতে এসেছি। কিন্তু যেখানে অনিয়ম, পক্ষপাত আর বহিরাগত হস্তক্ষেপ– সেখানে ফলাফল গ্রহণ করা মানে অন্যায়ের বৈধতা দেওয়া। নির্বাচন কমিশন বলেছে, সব অভিযোগ বিবেচনা করা হবে এবং প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত ঘোষণা আসেনি।
ক্যাম্পাসে বহিরাগতের বিষয়ে ছাত্রদলকে দুষছে শিবির : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের সময় ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ করার বিষয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে দায়ী করে সুন্দরভাবে ভোট গণনা ও ফল প্রকাশের দাবি জানিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত সমপ্রীতির শিক্ষার্থী জোট। বুধবার সন্ধ্যায় চাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রশিবির সমর্থিত এ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি ভোট নিয়েও বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন।
তার অভিযোগ, ছাত্রদলের আলাওল হলের জিএস প্রার্থী নুরুন্নবীসহ অনেকের সাথে বহিরাগত দেখা গেছে। অথচ আইডি কার্ড ছাড়া কেউই আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের কথা না। প্রশাসন বহিরাগত আটকাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরীফুল ইসলাম তুহিন ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সেক্রেটারি সরোয়ার হোসেন রুবেলের নেতৃত্বে শতশত ছাত্রদল–যুবদলের কর্মী ১ নম্বর রেল গেট সংলগ্ন রশিদ ছাত্রাবাসের সামনে অবস্থান নিয়েছে। সংবাদমাধ্যমে অনেক খবর আসার পরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
শিবিরের এই নেতা বলেন, হাতের যে কালি সেটা অমোচনীয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি ভোট দেওয়ার পরে সেই কালি উঠে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে আরো বেশি সর্তক হতে পারতেন। আইটি ভবনে ২১৪ নম্বর রুমে প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর ছাড়াই ১০–১৫টি ব্যালট পেপার বঙে ফেলা হয়েছে। অসতর্কতার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার। অসতর্কতার জন্য তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
তিনি শহীদ তরুয়া ভবন, এম রহমান হল ও আলাওল ভবনের এলইডি স্ক্রিন শুরু থেকে দুই ঘণ্টা বন্ধ থাকার তথ্য দিয়ে বলেন, সায়েন্স ফ্যাকাল্টির এলইডি স্ক্রিন প্রথম থেকে অধিকাংশ সময় বন্ধ ছিল। বারবার জানানোর পরেও প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে শিবিরের ভিপি প্রার্থী রনি বলেন, শুরুতে যখন অমোচনীয় কালির কথা বলেছি এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এটা নাকি জার্মান থেকে আমদানি করতে হয়। কিন্তু কথা ছিল অমোচনীয় কালিতে নির্বাচন হবে। আমরা তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারিনি। আমাদের অভিযোগগুলো লিখিতভাবে দাখিল করেছি। এখনো পর্যন্ত এসব বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত তা জানানো হয়নি।
৮ অভিযোগ তুলে তদন্ত চাইল ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পরে প্রশাসনের ‘একপেশে আচরণ’, স্বাক্ষরবিহীন ব্যালট বাঙে ঢোকানোসহ আটটি অভিযোগ তুলেছে সুফিবাদ আদর্শে বিশ্বাসী প্যানেল ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’। এ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ফরহাদুল ইসলাম বুধবার বিকালে চাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে করে বলেছেন, নির্বাচনে অনিয়মসহ আটটি অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের কাছে তুলে ধরেছেন। তারা এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত চান। নির্বাচনের কিছু অনিয়মের বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনকে আটটি বিষয় বলেছি। দীর্ঘদিন পর আকাঙ্ক্ষিত চাকসু নির্বাচন আয়োজন করায় আমরা মনে করেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির ভিন্নতা আসবে। গুণগত মান পরিবর্তন হবে। জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে সবার মাঝে বৈষম্যহীন মানসিকতা সৃষ্টি হবে। সব জায়গায় স্বচ্ছতা ফিরে আসবে।
চাকসু নির্বাচনের শুরুতে সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি থাকলেও প্রশাসনের একপেশে আচরণ, বিভিন্ন প্রার্থীর শৃঙ্খলা লঙ্ঘন করাসহ বিভিন্ন আপত্তিকর বিষয় উঠে এসেছে, যা এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ফরহাদুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি ভবনের ২১৪ নম্বর কক্ষে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার স্বাক্ষরবিহীন ২০টি ব্যালট পেপার বাঙে প্রবেশ করানো হয়েছে। দায়িত্বশীল প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জানানোসহ মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন কোনোধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।
অনিয়মের একগুচ্ছ অভিযোগ ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ প্যানেলের : চাকসু নির্বাচনে ভোট গ্রহণে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিচার ও তদন্ত দাবি করেছে বাম শিক্ষার্থীদের প্যানেল ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’। বুধবার বিকাল সাড়ে ৫টায় চাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে ভিপি পদপ্রার্থী ধ্রুব বড়ুয়া বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আজকের যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে সেই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা আমরা ব্যক্ত করেছিলাম। আজকের দিনটা একটি ঐতিহাসিক দিন ছিল এবং একটি ঐতিহাসিক দিন হতে পারত। সকালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা যে আগ্রহটা দেখেছিলাম, সে আগ্রহ আমাদের আনন্দিত করেছে। কিন্তু দুপুরের পরে বেশ কিছু ঘটনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যেগুলো এই নির্বাচনকে নানাভাবে কলঙ্কিত করেছে।
অভিযোগ তুলে ধরতে গিয়ে ধ্রুব বলেন, আমরা দেখছি যে, এখানে ভোটের সময়ে যে কালি আমাদের আঙুলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটি হল একটি মোচনীয় কালি। অর্থাৎ, এখানে অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হচ্ছে না। মানে দেওয়ার পরে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই কালি আসলে মুছে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি যে যখন ভোট নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কেন্দ্রে, সেখানে ভোটারদের সিগনেচার নেওয়া হচ্ছে না। যে কারণে একই ব্যক্তি একাধিক ভোট দানের যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে, আমরা মনে করছি তার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ৩৫৩ নম্বর কক্ষে একই আইডি দিয়ে দুইবার ভোটদান, নতুন কলা ভবনের একটি কক্ষে সাংবাদিকদের ঢুকতে না দেওয়া, নতুন কলা ভবনের এলইডি ডিসপ্লে ভেঙে ফেলা, ভোট গণনার সময় পোলিং এজেন্টদেরকে থাকতে না দেওয়ার হুমকির ঘটনা ঘটেছে। ধ্রুব বলেন, এই যে নানাভাবে অস্থিতিশীলতা আসলে তৈরি করা হচ্ছে, এটার দায় চাকসু নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে এবং সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে সেই অভিযোগগুলোকে মীমাংসা করতে হবে। এসব অভিযোগ তুলে ধরলেও ভোট বর্জন না করার কথা বলেন তিনি।
অনিয়মের অভিযোগ দ্রোহ পরিষদের : নির্বাচনে অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সমর্থিত প্যানেল ‘দ্রোহ পরিষদ’। প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ বলেন, আইটি ভবন কেন্দ্রে স্বাক্ষরহীন ২০টি ব্যালট পাওয়া গেছে, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার এক প্রার্থী ভোট কক্ষে প্রবেশ করে টোকেন বিলি করেছে। এসব অভিযোগ সমাধান না করে দুই কেন্দ্রের ভোট গণনা স্থগিতের দাবি জানান তিনি।
নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা ইনসানিয়াত বিপ্লবের : কারচুপির অভিযোগ এনে চাকসু নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লব স্টুডেন্ট ফ্রন্ট সমর্থিত প্যানেল ‘রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’। পুনরায় ভোটগ্রহণেরও দাবি করেছেন প্যানেলটির প্রার্থীরা। গতকাল বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে চাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে প্যানেলটির পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়।
প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী কেফায়েত উল্লাহ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজ পুরোদিন পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে। আমরা যখনই বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছি, তখনই প্রশাসনের দায়সারা আচরণ দেখতে পেয়েছি।
কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে ব্যালট পেপারে কারচুপি হয়েছে। ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে। এ সব ব্যাপারে আমরা অভিযোগ জানিয়েছি। তবে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব আমরা পাইনি।