সময় সুযোগ পেলেই বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারা আমার পুরনো অভ্যাস। আজ হতে পঁচিশ–ছাব্বিশ বছর আগের কথা। প্রয়াত গবেষক–শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হকের মালিকানাধীন আন্দরকিল্লা জেএমসেন হলের দক্ষিণ পাশে মোমিন রোডে অবস্থিত ‘কথাকলি’ বইয়ের দোকান থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বই কিনে নিয়ে পড়েছিলাম। ‘কথাকলি’ এখন নেই। তবে এ বইয়ের দোকানের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনি। আমার এই জীবনে যা বই সংগ্রহ প্রায়ই ‘কথাকলি’কে ঘিরে। এরপর চেরাগী পাহাড়ের নন্দন, শৈলী, বাতিঘর এবং ‘গ্রন্থনিলয়’ ঘুরে ঘুরে আমার মোটামুটি বিশাল বইয়ের সংগ্রহশালা। কথাকলি থেকে যে বইটি কিনে এবং পড়ে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছিলাম তার লেখক হলেন চট্টগ্রাম বাঁশখালীর জননন্দিত রাজনীতিক, সাহিত্যিক অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ। তিনি এখন প্রয়াত। ‘দাম শাসন দেশ শাসন’ নামে এই বইয়ে বেশ জোরালোভাবে গরিব ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের প্রতি একশ্রেণির বিত্তবান বিত্তশালী মানুষের কী উপেক্ষা–উপহাস তা সরস বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছেন এই জনদরদী সাহিত্যিক–রাজনীতিক আসহাব উদ্দিন আহমদ। বিশেষ করে বড় লোকের বিয়ে শাদিতে মেজবানে কতোভাবে যে অপচয়ের মচ্ছব চলে তার বাস্তব নির্মম চিত্র তুলে ধরেছেন তিনি। বিয়েতে শরিক বড় খ্যাতিমান বিত্তশালী লোকেরা একদিকে ভোজ উৎসবের নামে ঢালাও অপচয়ে শামিল হন, অন্যদিকে বিয়ে প্রাঙ্গণে বুভুক্ষু ক্ষুধার্ত পথশিশু কিংবা গরিবশ্রেণির লোকজন ভোজের টেবিল থেকে ছুঁড়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট–হাড্ডিমজ্জার স্বাদ আস্বাদনের জন্য তুমুল কাড়াকাড়ি করে–কী দারুণ উপভোগ্য তাই না? বিয়ে শাদি মেজবানে ভোজ উৎসবের নামে চলা অপচয়ের বাস্তব এই ফিরিস্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের লেখনীর ক্ষিপ্রতা সত্যিই আমাকে অবাক করেছে। যাঁরা তাঁর বইগুলো পড়েছেন তাঁরাও নিশ্চয়ই অভিভূত হবেন। দেশ ও সমাজে আমাদের চারপাশে নিত্য কী ঘটছে, গরিবেরা কতোভাবে যে বঞ্চনা, নিগ্রহ ও উপেক্ষার শিকার হচ্ছে তা জানা ও বোঝার জন্য তাঁর বইগুলো আপনাকে অবশ্যই পড়তে হবে। এক্ষেত্রে তাঁকে বিজ্ঞ দার্শনিক কিংবা সমাজবিজ্ঞানী বললেও বেশি বলা হবে না।
একটু ভেবে দেখুন, আমরা তো নিজ ঘরে দুই–চার পদের বেশি তরকারি দিয়ে ভাত খাই না। তাহলে বিয়ে শাদিতে দামি দামি মাছ মাংসের পাঁচ–সাত আইটেম দিয়ে যথেচ্ছ ভোজ উৎসবে কেন মজে থাকবো? অতো বেশি বাহারি পদের বিরানি কোরমা–পোলাও তথা দামি খাবার দাবারের এক বড় অংশই তো উচ্ছিষ্ট–অপচয় হচ্ছে তা আমরা কেন ভেবে দেখি না? আপনার টাকা পয়সা আছে বলেই হয়তো আপনি আট–দশ পদে দিব্যি আরামে–আয়েশে খাবার সারছেন, অথচ আপনার চারপাশে এমন অনেক গরিব অসহায় লোকও আছেন, যাদের পাতে সামান্য এক তরকারিও জুটে না। সামান্য ডাল ভাতও মুখে পুরতে লাখো কোটি গরিব মানুষের কী গলদঘর্ম দশা। কারণ গরিবের ডালও আজ দামি পণ্য হয়ে উঠেছে। ষাট টাকার কমে গরিবের মোটা চালও আজ জুটে না। মাছ মাংস ছাড়াই দিনের পরদিন শুধু শাকসবজি দিয়ে ডাল ভাত খাওয়া গরিব মানুষগুলোর জন্য আপনার কী এতটুকুও মায়া হয় না? এমনও দেখা যায়, প্রতিটি বিয়ের ক্লাবের সামনে দশ–পনেরো জন গরিব মানুষ সামান্য খাবারের আশায় জড়ো হয়। আপনি তো আট–দশ পদের ভোজ গ্রহণ করলেন। অথচ দীর্ঘক্ষণ ধরে খাবারের আশায় দাঁড়ানো এই গরিব লোকগুলোর প্রতি আপনি তাকানোর সময় পান না। ওরা বেশি আইটেম তো চায় না। দুয়েক পদের তরকারি দিয়ে হলেও তাদের পেট পুরে খেতে দেয়া যায়। দেখবেন এতেই তারা সন্তুষ্ট। আমার অগ্রজ শিক্ষাবিদ–গবেষক অধ্যাপক ড. নূ ক ম আকবর হোসেনের এক বক্তব্যের মাধ্যমে জেনেছি, ভারতীয় বংশোদ্ভূত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. অমর্ত্য সেন গবেষণা করে দেখিয়েছেন–খাদ্য সংকটের জন্য কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। বরং খাদ্যের অপচয়, অব্যবস্থাপনা তথা ‘মিস ম্যানেজমেন্টের’ কারণেই কোনো দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা তৈরি হয়। এটাই অমর্ত্য সেনের গবেষণা অভিসন্দর্ভ। সব মানুষই স্রষ্টার কালজয়ী সৃষ্টি। কাউকে গরিব করে রাখা স্রষ্টার উদ্দেশ্য নয়। বরং সারা বিশ্বে আজ মানুষই মানুষের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে রেখেছে। মানুষই মানুষের হক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। অথচ সম্পদের সুষম বণ্টন হলে আজ পৃথিবী থেকে চিরতরে দারিদ্র্যের অবসান ঘটতো। ‘দারিদ্র্য’ শব্দটিকে সত্যিই জাদুঘরে পাঠানো যেত দুনিয়ার সব মানুষ মানবিক, দরদী ও সহমর্মী হলে।
আমি হোটেল রেস্তোরাঁয় বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে মাঝে মধ্যে চা–নাস্তা করি। পকেটে টাকা থাকলে কখনো নিজে বিল দেই। আবার কখনো বন্ধু–বান্ধবরা জোর করে চা নাস্তার বিল দিয়ে দেয়। একটা ব্যাপার প্রায়ই লক্ষ্য করি, তিন চারজন মিলে চা নাস্তা করলে কিংবা বেশিরভাগ সময় দুইজন চা–নাস্তা বা খানাপিনা খাওয়ার পর যখন বিল পরিশোধের সময় আসে কী তুমুল হুড়োহুড়ি চলে কার আগে কে বিল দেবেন! হোটেলের ক্যাশবক্সের সামনে এই বিলদাতাদের মধ্যে চলে কী তুমুল প্রতিযোগিতা? এমনও দেখা যায় কেউ একজন বিল ক্যাশে জমা দিয়েছেন, অন্যরা বা অন্য বন্ধুরা এই টাকা ফেরত দিতে বাধ্য করেন ক্যাশ ম্যানেজারকে। টাকা দিতে মরিয়া দুই বা ত্রিপক্ষীয় ঠেলাঠেলিতে আস্ত টাকার নোট ছিঁড়ে গেছে এমন দৃশ্যও অনেক সময় দেখা গেছে। বিল পরিশোধের সময় তখন হোটেলের ক্যাশবক্সের সামনে একটা কথাই খুব জোরে জোরে শোনা যায় চট্টগ্রামী ভাষায় ‘টেঁয়া আঁই দি, আঁই দি,’ কিংবা সোজা বাংলায় অন্যরা বলেন, ‘টাকা আমি দিচ্ছি, আমি দিচ্ছি, আপনি দেবেন না।’ অবাক ব্যাপার যে, ক্যাশবাক্সে চা নাস্তার বিল আগে জমা দিতে এমন ব্যতিব্যস্ত লোকগুলোই কিনা হোটেলের বাইরে গিয়েই অন্যরকম হয়ে যান। তখন তাঁরা ভিন্ন রূপের ভিন্ন চেহারার মানুষ বনে যান। এই গরিব দেশে প্রতিটি হোটেল–রেস্তোরাঁর বাইরে গরিব–ফকির জাতীয় দুই তিনজন লোক বা দুস্থ নারী পথশিশুর অবশ্যই দেখা মেলে। যারা এই হোটেল ফেরত মানুষগুলোর সামনে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দেয়। দুই পাঁচ–দশ টাকা পেলেই তারা খুশি। কিংবা কেউ একজন দরদী হয়ে তাদের হাতে সিঙ্গারা চমুচা ডালপুরি বা রুটি–পরোটা তুলে দিলে তাতে তাদের চেহারা খুশিতে টগবগ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আগে শত শত টাকার চা নাস্তা খানাপিনার বিল দেয়ার জন্য ওই লোকগুলো একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। কিংবা বিল দিতে না পেরে চরম অসন্তুষ্টির ভাব দেখালো। তারাই কিনা এখন কয়েকজন ভিখারীর সামনে ‘পাষাণ হৃদয়ের মানুষ’ হয়ে উঠলেন। তাঁদের পকেট থেকে পাঁচটি টাকাও এই গরিবদের জন্য তখন বের হয় না। তাঁদের কেউ বলেন না, ‘যান, হোটেলের ভেতরে ঢুকেন, চা–নাস্তা খানাপিনা কী খাবেন খান। টাকা আমি দেবো।’ একটু আগে আপনি বন্ধু বান্ধবদেরকে চা–নাস্তার বিল দিতে দিলেন না। নিজেই সব টাকা দিলেন। না হয় আর বিশ–পঁচিশ টাকা বেশি খরচ হবে হয়তো। গরিবের হাসিখুশিতেই আল্লাহ পাক খুশি হন যা আমরা ছোট বেলায় কবিতায় পড়েছি। কোথায় আমাদের মানবতা আর মানবিকতা! বন্ধু বান্ধবদের সামনে নিজের ক্যারিশমা তুলে ধরতে এবং নিজের তথাকথিত ভাবমর্যাদা উজ্জ্বলতর করতে আমরা কতো মেকি চেষ্টাই না করে থাকি। বাইরে ভদ্রতার বেশ–ভুষা। ভেতরে ভেতরে কেউ কেউ অন্যরকম। এই মুখ ও মুখোশ কেন? আমাদের মাঝে বিবেক উপলব্ধি জাগ্রত হোক এই প্রত্যাশাই করি।
লেখক: সাংবাদিক