বর্তমানে অস্থির একটা সময় পার করছে মানবকুল। এই অস্থিরতা বিরাজ করছে আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে, এবং একই সাথে পুরো বিশ্বে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার নিয়ম–কানুন, ব্যক্তি কেন্দ্রিক মতদ্বৈততা, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অসহিষ্ণুতা, উগ্রবাদসহ আরো নানা বিষয়ে মানুষে–মানুষে, রাষ্ট্রে–রাষ্ট্রে দ্বন্দ্ব প্রতীয়মান হচ্ছে। নিজের চিন্তাধারা ও মতবাদের সাথে না মিললেই করা হচ্ছে ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় আক্রমণ। এ কারণে সমাজে বাড়ছে আক্রোশ ও বিবাদ, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অস্থিরতা, সমন্বয়হীনতা। বিশ্বায়নের ফলে অপরের অধিকারগত সেবা হরণ, সাইবার হামলাসহ ধর্মের দোহাই দিয়ে চলছে রাষ্ট্র দখেলর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। পত্রিকার পাতা খুললেই আমরা দেখতে পাই অশান্তি, অরাজকতা, যুদ্ধের উন্মত্ততা এই শান্ত পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে। আর এর প্রভাব নেমে আসছে দেশ থেকে শুরু করে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা, এবং সর্বধর্ম সমন্বয়। যা স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগোয় অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে উল্লেখ করেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, ‘যদি কেউ নিজের ধর্মের একচেটিয়া বেঁচে থাকার এবং অন্যের ধ্বংসের স্বপ্ন দেখে তবে তাকে বলি, শীঘ্রই প্রতিটি ধর্মের পতাকায় শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও লিখিত হবে: বিবাদ নয়; সহায়তা, বিনাশ নয়; পরস্পরের ভাবগ্রহণ, মতবিরোধ নয়; সমন্বয় ও শান্তি‘। অর্থাৎ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান অসহিষ্ণুতা, জাতিগত বিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতার অবসান করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন তাঁর ঐ বক্তৃতায়। প্রায় চার মিনিটেরও কম সময়ের ছোট্ট কিন্তু দুর্দান্ত ভাষণটির প্রভাব এত ছিল যে, হলভর্তি শ্রোতারা তাঁকে দাঁড়িয়ে দুই মিনিটেরও বেশী সময় স্থায়ী করতালির মাধ্যমে সম্ভাষন জানিয়েছিল। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতি ও সমঝোতা স্থাপনে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ধর্ম সম্পর্কে তার বিখ্যাত বক্তৃতা প্রণিধানযোগ্য। পশ্চিমে স্বামিজীর বক্তৃতা তৎকালীন ভারতবর্ষের বাইরে হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসের সংশোধন ও উন্নতি সাধন করেছে এবং সমস্ত ধর্মের মধ্যে পাওয়া সর্বজনীন ঐশ্বর্যের ভাবটা ফুটে উঠেছিল। তৎকালীন পাশ্চাত্যেবাসীর মন উদার এবং চিন্তাভাবনার প্রসারণের কৃতিত্ব অবশ্যই নিঃসন্দেহে এক এবং একমাত্র একমাত্র স্বামী বিবেকানন্দকেই দিতে হবে। তিনিই পশ্চিমের সামনে প্রাচীন হিন্দু চিন্তার রত্ন স্থাপনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং এভাবেই তাদের নৈতিক কল্পনাশক্তির মাত্রা ও গভীরতা আরও প্রশস্ত করতে তাদের সহায়তা করেছিলেন।
ধর্ম মহাসম্মেলনের উদ্দেশ্য ও পরিপূর্ণতার ব্যাপারে যদি বলতে হয় তাহলে উল্লেখ করতে হয়, আমেরিকানদের তৎকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি এবং জাতীয় সম্পদে অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে আমেরিকা বৈশ্বিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। আমেরিকানরা তাদের এ অর্জনকে একটি উপযুক্ত উপায়ে উদযাপন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সাথে সাথে এটিও একটি আনন্দের কাকতালীয় ঘটনা ছিল যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকার আবিষ্কারের চারশত শতবর্ষ ও পূর্ণ হয়েছিল। আয়োজকদের মূল ধারণাটি ছিল বিশ্বে খ্রিস্টান বিশ্বাসের আধিপত্য প্রমাণ করা। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সম্ভাষণে নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন এভাবে– আমি এমন একটি ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে গর্বিত, যে ধর্ম বিশ্বকে সহনশীলতা এবং সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা উভয়ই শিখিয়েছি। আমরা কেবল সর্বজনীন সহনশীলতায় বিশ্বাস করি না তবে আমরা সমস্ত ধর্মকেই সত্য হিসাবে গ্রহণ করি। আমি এমন একটি জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গর্ববোধ করি যেটি নির্যাতিত এবং সমস্ত ধর্ম এবং পৃথিবীর সমস্ত জাতির শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। এটাই সর্বোচ্চ ভ্রাতৃত্ববোধের আহ্বান ছিল।
বিশ্বে বিরাজমান ধর্মমত সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল, নদীসমূহ বিভিন্ন স্রোতে, বিভিন্ন উৎস হতে উৎপন্ন হয়ে একই সমুদ্রের পানিতে মিশে যায়। একইভাবে ধর্মমত গুলোর ক্ষেত্রেও উদযাপনের পদ্ধতি বিভিন্ন হলেও আমরা একই পরমাত্মার সন্ধানে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করছি। শুধু আমার ধর্মের মাধ্যমেই বিধাতাকে পাওয়া যাবে এ মতবাদের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। তাঁর মতে বিধাতার বক্তব্য হলো– যে কেউ, যেকোন রূপেই আমার কাছে প্রার্থনা করুক না কেন, আমি তাদের আহবানে সাড়া দিই এবং কাছে পৌঁছে যাই; সবধরণের সাধনার পথে আমাকে পাওয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা, গোঁড়ামি এবং এর ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মান্ধতা দীর্ঘকাল ধরে এই সুন্দর পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। এটি পৃথিবীকে সহিংসতায় ভরিয়ে দিয়েছে, এবং প্রায়শই মানুষের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছে আমাদের এ সুন্দর পৃথিবী, সভ্যতা ধ্বংস করেছে, এমনকি কোন কোন দেশকে হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে । যদি এই ভয়াবহ দানবগুলির অস্তিত্ব না থাকতো, তবে মানব সমাজ এখনকার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হতো। কিন্তু আজ সময় এসেছে; এবং আমি দৃঢ়ভাবে আশা করি যে, এই সম্মেলনের সম্মানে আজ সকালে যে ঘণ্টাটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে তা সমস্ত ধর্মান্ধতার, তলোয়ার বা কলমের সাহায্যে পরিচালিত সমস্ত নিপীড়নের সমাপ্তি ঘোষণা করবে। বর্তমান বাস্তবতায় এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ধর্মচিন্তা এবং ধর্মমতের বিভিন্নতা কোনদিনই মুছে যাবেনা। তাই, বিশ্বে ধর্মীয় সংঘাতহীন সহাবস্থানের জন্য এই নানা পথের বাস্তবতা স্বীকার করা ব্যতীত শান্তির কোন সম্ভাবনা নেই।স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোয় ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ সালে সমাপনীয় ভাষণে বলছিলেন, বিবদমান ধর্মীয় কোন্দলকে মিটিয়ে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক মসৃণ করার চেষ্টায় আমাদের নিয়োজিত থাকা উচিত। এ ধর্মসম্মেলন আমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈপরীত্যের মধ্যেও সাধারণ সম্প্রীতির যে আবহ তৈরি করেছে তাঁর জন্য আয়োজন কমিটি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। ধর্মীয় ঐক্যের সাধারণ ক্ষেত্র সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়ে থাকে। তবে এখানে যদি কেউ আশা করে যে এই ঐক্যটি যে কোনও একটি ধর্মের বিজয় এবং অন্যের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আসবে, আমি তাকে বলি, “ভাই, আপনার পক্ষে এটি একটি অসম্ভব আশা।” স্বামীজির স্পষ্ট উচ্চারণ – খ্রিস্টানকে হিন্দু বা বৌদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই; তবে প্রত্যেককে অবশ্যই অন্যের ধর্ম বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে হবে এবং তার স্বতন্ত্রতা রক্ষা করতে হবে। এভাবেই তিনি মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে, মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে এই পৃথিবীতে সবাই আমরা অপরের ভাই। তিনি বলেছিলেন, আমার আদর্শ বস্তুত অতি সংক্ষেপে প্রকাশ করা চলে, আর তা এই মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত দেবত্বের বাণী প্রচার করতে হবে এবং সেই দেবত্ব–বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালেই দেখি, শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বে প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন জোট ও সংঘ সৃষ্টি হচ্ছে এবং চুক্তি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই কোনটাই কি চূড়ান্ত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে? নাকি জোটগুলো গঠিত হচ্ছে, এক জোট অন্যজোটের উপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। আমরা যদি গভীরভাবে উপলব্ধি করি তবে দেখতে পাব ব্যাপারটি আসলে তাই। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা, প্রতিশোধপরায়ণতা ও ধর্মান্ধতার জায়গা থেকে বিশ্বে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এ ধরনের জোটগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি লাখ টাকার প্রশ্ন যে , এ ধরনের জোট দিয়ে আদৌ বিশ্বে শান্তি স্থাপন করা যাবে কিনা? এক কথায় উত্তর হচ্ছে না। এ ধরনের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পুরো বিশ্বে একটি আদর্শ স্থাপন করতে হবে যা হলো ভ্রাতৃত্ববোধ। আর সেটিই বিবেকানন্দ তার শিকাগো বক্তৃতায় উদ্ধৃত করার চেষ্টা করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। এ সম্বন্ধে তিনি বলছিলেন “সর্বধর্মসমন্বয়ের অর্থ যদি এই হয় যে, কতকগুলো বিশেষ মত জগতের সমস্ত লোকে বিশ্বাস করিবে, তাহা হইলে তাহা সম্পূর্ণ অসম্ভব। ইহা কখনো হইতে পারে না। যখন এই জগৎ ধ্বংস হইবে, তখনই কেবল সাম্যরূপ ঐক্য আসিতে পারে; অন্যথা এরূপ হওয়া অসম্ভব। এই পার্থক্য, এই বৈষম্য, আমাদের পরস্পরের মধ্যে এই সাম্যের অভাবই, আমাদের উন্নতির প্রকৃত উৎস, উহাই আমাদের যাবতীয় চিন্তার প্রসূতি।চিরকাল এইরূপেই চলিবে।” তাহলে বিশ্বব্যাপী শান্তির জন্য, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মের ভূমিকা কি? স্বামী বিবেকানন্দের মতে, “আমাদেরকে স্বীকার করিতে হইবে যে,একই সত্য লক্ষ ভাবে প্রকাশিত হইতে পারে এবং প্রত্যেক ভাবটিই তাহাদের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যথার্থ। কোন বিষয়কে শত প্রকার বিভিন্ন দিক হইতে দেখা চলে,অথচ বস্তুটি একই থাকে“। তিনি মূলত সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা, গোঁড়ামী ও ধর্মোন্মত্ততার অবসানকল্পে দেশ–কাল–পাত্রের রুচিবৈচিত্র অনুসারে অধ্যাত্ম–চিন্তার স্বাধীনতা তথা ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সমন্বয়ের বৈদান্তিক ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর বক্তৃতায়। তাই তাঁর বক্তৃতা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আজও খুবই প্রাসঙ্গিক। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এই মহান মনীষীকে।
লেখক : প্রফেসর, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়