বিবাহ বিচ্ছেদের মতো চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হাজারবার চিন্তা করা উচিত

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৯ নভেম্বর, ২০২৪ at ৮:৪২ পূর্বাহ্ণ

এই বিশ্বব্রম্মাণ্ড টিকে আছে ভালোবাসার উপর। ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী আজো এতো সুন্দর। এটি না থাকলে বহু আগে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো। এই যে মানুষে মানুষে এতো দৃঢ় বন্ধন এটির মূল রহস্য একমাত্র ভালোবাসা। ভালোবাসার জন্য মানুষ অকাতরে জীবন দিতে পারে। পারে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে। এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে। ভালোবাসার পরিপূর্ণতা লাভ করে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে। সেজন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ভালোবাসাকে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিবাহ বন্ধন মানব জাতির জন্য একটি আনন্দদায়ক উপলক্ষ। বাংলাদেশের মানুষও এই উপলক্ষ্যের বাইরে নয়।

ইদানীং দেশে বিবাহের হার বেড়েছে। বেড়েছে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের হারও। বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং দাম্পত্য জীবন পালনে অক্ষমতা (বনিবনার অভাব)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস২০২২’ জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য। জরিপটি ২০২৪ সালের ৩১ শে জানুয়ারি প্রকাশ করা হয়। জরিপে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে তিন লাখের বেশি পরিবার। এতে দেখা যায়, মহামারির সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার কারণে বিয়ে উৎসাহিত হয়নি। ২০২২ সালে সংকট কেটে যাওয়ায় বিয়ে বেড়েছে। ২০২২ সালে ১৫ বছরের অধিক বয়সী মানুষের মধ্যে বিয়ের হার পাওয়া গেছে হাজারে প্রায় ২৫। ২০২১ সালে এই হার ছিল ১৮.৫।

জরিপ প্রতিবেদনে ২০০৬ সাল থেকে সাধারণ বিয়ের হারের গতিধারা তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, সাধারণ বিয়ের হার এক বছরে অনেক বেড়েছে। আগের বছরগুলোতে ছিলো ১৭২১ এর মধ্যে। ২০২২ সালে বিয়ের হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে করোনাকালের অর্থনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার সম্পর্ক দেখছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। শহরের চেয়ে গ্রামে এ হার বেশি। সাধারণ বিয়ের হারে নারীপুরুষের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। তবে ধর্মভেদে তারতম্য দেখা যায়। মুসলমানদের মধ্যে বিয়ের হার বেশি প্রায় ২৬। হিন্দু সমপ্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রায় ১৮। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রে প্রায় ১৫। জরিপে নারী ও পুরুষেরা প্রথম বিয়ে কত বছর বয়সে করেছেন, তার একটি গড় হিসাব উঠে এসেছে। এতে পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ছিল ২৪ বছর। নারীর ক্ষেত্রে ১৮.৪ বছর। শহরে পুরুষ ও নারীদের বিয়ের গড় বয়স একটু বেশি তবে গ্রামে কম। তবে যেসব কারণে বিচ্ছেদ হয় তা হলোবিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব, পারিবারিক সহিংসতা, যৌনজীবনে অপূর্ণতা, দারিদ্র্য ও টানাপোড়েন, সন্তানের কোনো সমস্যা নিয়ে মতানৈক্য, মানসিক রোগ (ব্যক্তিত্বের সমস্যা,মাদকাসক্তি), বাল্যবিবাহ, জীবনে ঘটে যাওয়া বড় কোনো দুর্ঘটনা বিপর্যয় ইত্যাদি।

তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের দুই ধরনের হার বিবিএসের জরিপে পাওয়া পায়। একটি হলো স্থূল অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার। অন্যটি সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার, যেখানে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের হিসাব করা হয়। বিবিএস বলছে, তারা বিচ্ছেদ হওয়া মানুষের নিবিড় সাক্ষাৎকার নিয়ে জরিপ করেছে। ফলে এই জরিপের মাধ্যমেই বিচ্ছেদের আসল কারণ উঠে এসেছে। বিবিএসের হিসাবে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থূলবিচ্ছেদের হার ০..১ এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে বেড়ে ১.এ দাঁড়িয়েছে।

সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হারটি হিসাব করা হয়েছে নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে। দেখা যায়, ২০২১ সালে নারীদের সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার ছিল ২ এর সামান্য কম। সেটা পরের বছর বেড়ে ৩.৬ এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২ এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে ৩.৮ এ দাঁড়ায়। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩% এই কারণ সামনে এনেছেন। এরপর রয়েছে দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা প্রায় ২২%। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ঢাকা বিভাগে, কম ময়মনসিংহ বিভাগে। দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতায় বিবাহবিচ্ছেদ বেশি বরিশালে, কম সিলেটে। ভরণপোষণ দিতে অসমর্থতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি রাজশাহীতে, কম চট্টগ্রামে। পারিবারিক চাপে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি ময়মনসিংহে, কম ঢাকায়। নির্যাতনের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি ময়মনসিংহে, কম রাজশাহীতে। যৌন অক্ষমতা অথবা অনীহার কারণে রংপুরে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি হয়েছে। বরিশালে এ ক্ষেত্রে হার শূন্য। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তালাকের ঘটনা বেশি ঘটছে সিলেটে। আইনত হিন্দু সমপ্রদায়ে বিবাহবিচ্ছেদের সুযোগ নেই। তবু অনেকে ‘আলাদা’ হচ্ছেন। হিন্দু নারীদের মধ্যে মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য না করার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসলমানদের মধ্যে তালাকের ঘটনার কারণগুলো জাতীয় হারের মতোই। কিন্তু হিন্দু সমপ্রদায়ের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘আলাদা’ হওয়ার কারণের ব্যতিক্রমী চিত্র দেখা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে আলাদা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ দাম্পত্যজীবন বজায় রাখতে অক্ষমতা ও শারীরিক নির্যাতন।

শারীরিক নির্যাতনকে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মুসলমানদের প্রায় ১০%। হিন্দুদের ক্ষেত্রে হারটি ২০%। হিন্দু নারীদের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার হার বেশি। এর সঙ্গে যৌতুকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। হিন্দু নারীরা যেহেতু বাবার সম্পত্তির ভাগ পান না, সেহেতু তাঁদের উপর যৌতুক আনার চাপ থাকে। হিন্দু নারীদের মধ্যে অনেকেই দাম্পত্য জীবনে সুখী হন না। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে সেটা মেনে নিয়ে সংসার করে যান। অবশ্য অনেকেই দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তবে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বিয়ে টিকিয়ে রাখার পক্ষে একটা বড় নিয়ামক। অনেকে বিয়ের অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই মনে মনে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু ভাবেন সন্তানদের একটু বড় করে বিচ্ছেদে যাবেন। তবে মাবাবার বিচ্ছেদ যখনই হোক না কেন বা সন্তানের বয়স তখন যতই হোক, সেটা তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একেক বয়সে হয়তো একেক রকম প্রভাব পড়ে কিন্তু সবই নেতিবাচক। আর দীর্ঘ দাম্পত্যের পরে বিচ্ছেদ ডেকে আনতে পারে দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্নতা। তবে ডিভোর্স কারো কারো জন্য মানসিক চাপ কমানোর উপায়ও বটে। অনেককে দীর্ঘমেয়াদি যন্ত্রণা, নির্যাতন থেকে মুক্তি দেয় এই বিচ্ছেদ। এদিকে নানা আর্থসামাজিক কারণে দেশে বাল্যবিবাহও বেড়েছে। জরিপ বলছে, ১৮ বছরের আগে বিয়ে হওয়া নারীর অনুপাত (২০২৪ বছর বয়সী) ২০২২ সালে পাওয়া যায় প্রায় ৪১%, যা আগের বছর ছিল প্রায় ৩২%

তবে অবস্থা যাই হোক না কেন, এক জীবনে মানুষের সমস্ত চাওয়া পাওয়া কখনো পূরণ হয় না। তাই ধৈর্য ধরে দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখাই হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। ক্ষণিকের উত্তেজনায় বা চাওয়া পাওয়ার অসংগতির জন্য বিচ্ছেদের মত চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ মানুষ একটা বয়সের পর সংগ দেওয়া মানুষের বড়ই অভাব অনুভব করে। তখন দৈহিক চাহিদা থেকেও মানসিক ও সামাজিক চাহিদা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আর বয়স যত বাড়ে স্বামীর প্রতি স্ত্রী ও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর নির্ভরতা তত বাড়ে। তাই বিবাহ বিচ্ছেদের মত চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হাজারবার চিন্তা করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষার মূল লক্ষ্য ভালো মানুষ তৈরি করা
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে রাবার শিল্প : একটি পর্যালোচনা : ২