মোখার মূল ঝাপটাটি গেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপর দিয়ে। অতি প্রবল এই ঝড়ের তাণ্ডবের পূর্ণ চিত্র পাওয়া না গেলেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ উপকূল অতিক্রম করে শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড়। এর কেন্দ্র আঘাত হানে রাখাইনের রাজধানী সিত্তের উপর দিয়ে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, মোখার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও উত্তর–পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জরুরি সহায়তা দরকার এবং ১২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রামানাথন বালাকৃষ্ণান বলেন, যে অঞ্চলটিতে আগে থেকেই মানবেতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সেখানে এখন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত একটি দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। হাজার হাজার মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর আগের দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে যাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এরই মধ্যে নিঃশেষিত। খবর বিডিনিউজের।
মিয়ানমারে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) প্রতিনিধি টিটন মিত্রের বরাতে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির উপকূলীয় এলাকার ২০ লাখ মানুষ মোখার আঘাতের ঝুঁকিতে রয়েছে। টিটন মিত্রর টুইটারের পোস্টের বারতে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকাটি জানিয়েছে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের সামরিক তথ্য দপ্তরের বরাতে ওয়াশিংটন পোস্ট আরও লিখেছে, ঝড়ের আঘাতে সিত্তে, চিয়াওকপিউ ও গওয়া শহরতলীর বাড়িঘর, বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার, মোবাইল ফোন টাওয়ার, ল্যাম্পপোস্ট ও অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা আরও জানিয়েছে, মোখার সৃষ্ট ঝড়ো বাতাসে ইয়াংগুন থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে কোকো দ্বীপের একটি ক্রীড়া ভবনের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় সূত্রের বরাতে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে, সিত্তে শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, সেখানকার রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরের নিচতলায় পানি জমেছে। ওই অঞ্চলের বেশিরভাগ টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান লিন লিন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে জানিয়েছিলেন, ধারণার চেয়ে বেশি মানুষ সিত্তে শহরে জড়ো হওয়ায় সেখানে খাদ্য ও আশ্রয় কেন্দ্রে সংকট দেখা দিয়েছে। সিত্তে শহরের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের উঁচু এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হলেও তাদের জন্য খাবার বা পানির কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।
সিত্তের বাসিন্দা জাও মিন তুন বলেন, রাজ্য সরকার আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে শুরু করে। তাদের খাবার দেওয়া হয়নি, ফলে তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন পার করছে।
গতকাল সকাল পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়া ও প্রবল বর্ষণের জেরে মিয়ানমারে কয়েকজনের প্রাণহানি হয়েছে।
সেদেশের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য শানের ফেইসবুক পেইজে জানানো হয়, তাচিলেইক শহরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এক দম্পতির লাশ উদ্ধার করেছে, যারা প্রবল বর্ষণে ভূমিধসে মাটি চাপা পড়েছিলেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় মানদালে অঞ্চলে পাইইন উ লওইন শহরতলীতে বটগাছের চাপায় আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। মোখার প্রভাবে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে বেশি জোয়ারের পানিতে সিত্ত শহরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে।
মিয়ানমারের জান্তার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাখাইন রাজ্য ও আশপাশের এলাকার ৭৮ হাজারের বেশি বাসিন্দাকে উপকূলীয় ও ঝূঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সূত্র অবশ্য বলছে, আশ্রয় গ্রহণকারীর এই সংখ্যা এক লাখের বেশি হতে পারে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) বরাতে রয়টার্স জানায়, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে সংস্থাটি মিয়ানমারের জন্য খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তা প্রস্তুত করছিল, যা চার লাখ মানুষের এক মাসের সংস্থান করতে পারে।
২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের আঘাতেও লণ্ডভণ্ড হয়েছিল মিয়ানমারের উপকূলীয় অঞ্চল। সেবার ওই ঝড়ের আঘাতে ইরাবতী বদ্বীপ অঞ্চল ও এর আশপাশের এলাকায় অন্তত ১ লাখ ৩৮ হাজার জনের মৃত্যু হয় এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ধ্বংস হয়।