বিপদের মুহূর্তে নির্ভরতার প্রতীক ৯৯৯

চট্টগ্রামে এক বছরে ১৫ হাজার ৯০০ কল

ঋত্বিক নয়ন | শুক্রবার , ২৬ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৭:৫৮ পূর্বাহ্ণ

অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সংকট মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছে ‘জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯’এর কার্যক্রম। সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের মানুষের কাছেও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯৯। অসুস্থ রোগীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, জঙ্গি আস্তানার সন্ধান, অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো দুর্ঘটনা, বাড়িতে ডাকাতের হানা, ধর্ষকের কবল থেকে বাঁচার আকুতি, প্রতারকের প্রলোভন, ইভটিজিংয়ের প্রতিকারসব সমস্যার সমাধান যেন ৯৯৯।

৯৯৯এ ফোন করে ঝামেলা এড়িয়ে সহজে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা পাচ্ছে মানুষ। প্রতিদিন গড়ে পঁচিশ হাজার নাগরিক কল করছে এই জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯এ।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯এর গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার এ প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, অভ্যন্তরীণ নানা সংকট মোকাবেলা করে আমরা সেবা দিয়ে চলেছি পাবলিককে। তবে আশার কথা হলো এটিকে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এটি হলে আমরা আরও বেশি সেবা দিতে পারবো। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য যাত্রা শুরু করে ৯৯৯। কিন্তু এই জাতীয় জরুরি সেবা৯৯৯ এখন দেশের মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয়।

জাতীয় জরুরি সেবা৯৯৯ এর তথ্যমতে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর উদ্বোধনের পর থেকে গতবছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ সর্বমোট ৫,১৮,৫৩,১৭৫ টি কল রিসিভ করে। যার মধ্যে ২,১৯,৯৬,২৭১ টি কলের বিপরীতে সেবা প্রদান করা হয়। এই কলসমূহের মধ্যে ১৫,৭৫,৫২৩ টি জরুরি কলে সাড়া দিয়ে পুলিশ, ফায়ার এবং এ্যাম্বুলেন্স জরুরি সেবা প্রদানে সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে সেবা প্রদান করে। এর মধ্যে ১৩,০১,০৭৫ টি কলের বিপরীতে জরুরি পুলিশি সেবা, ,৩২,১৭২ টি কলের বিপরীতে জরুরি ফায়ার সার্ভিস সেবা এবং ১,৪২,২৭৬ টি কলের বিপরীতে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান করা হয়। গত বছর চট্টগ্রাম নগরী ও জেলা থেকে ৯৯৯ এ ১৫ হাজার ৯০০ কল করা হয়। এরমধ্যে মারামারি সংক্রান্ত কল সবচেয়ে বেশি। ৭৩১২টি কল করা হয় এ সংক্রান্ত। এরপরে জমিজমা বিরোধ সংক্রান্ত কল রয়েছে ২৮০১টি, নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত কল ২০৩২টি, দুর্ঘটনাজনিত কল ১৯৫৪টি এবং অগ্নিকাণ্ড সংক্রান্ত কল ১৮০১টি।

পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, চট্টগ্রামসহ সারা দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কল আসে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত। যেখানে যৌন হয়রানি থেকে বাল্য বিবাহ, ইভটিজিং পর্যন্ত সবই আছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা, জায়গাজমি সংক্রান্ত বিরোধ, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি। আছে আত্মহত্যা সংক্রান্ত ঘটনাও।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, কেউ একজন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ৯৯৯এ ফোন করে জানান যে তিনি আত্মহত্যা করতে চলেছেন। তখন দ্রুত পুলিশ টিম গিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। আবার বাড়ির কোনো সদস্য এ কাজ করলে অন্য সদস্যদের কেউ আমাদের কল দিয়ে জানায়। এরকম অসংখ্য ঘটনায় আমরা ভিকটিমকে শেষ মুহূর্তে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে সমস্যা সংক্রান্ত কল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে কিংবা গহীন কোন স্থন বা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলা ট্যুরিস্টদের উদ্ধার সংক্রান্ত বিষয়ে ৯৯৯ কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ইঞ্জিন বিকল হয়ে মিয়ানমার জলসীমায় জেলেসহ আটকে পড়ে একটি মাছ ধরার ট্রলার। ৯৯৯ নম্বরে ফোনকল পেয়ে মিয়ানমার নৌবাহিনীর হেফাজত থেকে ১৫ জন জেলেদের উদ্ধার করা হয় গত ১৫ জানুয়ারি। এর আগে ৩ জানুয়ারি আনোয়ারার গহিরা উপকূল থেকে মামণি নামে একটি মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে তারা সাগরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি বেড়াতে এসে কাপ্তাই হ্রদে জেগে ওঠা টিলায় আটকে পড়ে চট্টগ্রাম কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি লঞ্চ। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে এই ১৭৫ জন পর্যটককে উদ্ধার করা হয়। একই বছর ১১ মে ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে খৈয়াছড়া ঝর্ণায় ঘুরতে এসে পাঁচ বন্ধু দিক ভুল করে হারিয়ে যান বনের গভীরে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলে কোনো উপায়ান্তর না দেখে ফোন দেন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ। পরে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি চেষ্টায় ওই পাঁচ বন্ধুকে উদ্ধার করে পুলিশ।

বাল্য বিয়ে ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে ৯৯৯ : প্রতিষ্ঠার পর থেকে গতবছর নভেম্বর পর্যন্ত ২৫,৯১৭ টি বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ এবং ৭০,৪৬৭ জন নারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম সহিংসতার কলে সেবা প্রদান করেছে। শুধুমাত্র ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এগার মাসে ৬,২৫৮ টি বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করেছে। একইসাথে ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এগার মাসে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত ২৪,৮৪২ টি কলে সেবা প্রদান করা হয়েছে।

৯৯৯ এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : একটি মূল ও অভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে জরুরি পরিস্থিতিতে কত কম সময়ে রেসপন্স করা যায়, সেটা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। বর্তমানে যেখানে সেবা দিতে গড়ে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় লেগে যায়, এই রেসপন্সের সময়কে যাতে ১০ মিনিটের নিচে নামিয়ে আনা যায় তা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ।

ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার স্থাপন : বর্তমানে ১০০ ওয়ার্ক স্টেশনে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কলসেন্টার রয়েছে। কল গ্রহণ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও ১০০ ওয়ার্ক স্টেশনের একটি ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো কারণে বর্তমান সার্ভিস সেন্টারটি বন্ধ হয়ে গেলে সাথে সাথে ডিআর সেন্টার থেকে সেবা প্রদানের কার্যক্রম শুরু করার জন্য একটি ডিআর সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

থানা ও ফায়ার স্টেশন অটোমেশন : ইতিমধ্যে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ সকল থানাকে একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং ব্যবস্থাপনার (থানা ডেসপাস সিস্টেম) মধ্যে নিয়ে আসার কার্যক্রম গ্রহণ করে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে। একইভাবে দেশের সকল ফায়ার সার্ভিস স্টেশনকে কেন্দ্রীয় মনিটরিং ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

টহল গাড়িতে এমডিটি সংযোজন : পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি থানার টহল গাড়িতে এমডিটি সংযোজন করা হবে। মোবাইল ডাটা টার্মিনাল (এমডিটি) টহল গাড়িগুলোকে ৯৯৯ এর সাথে সম্পৃক্ত করবে, ফলে যে কোনো ঘটনায় রেসপন্স টাইম কমে যাবে।

৯৯৯ নম্বরে মিথ্যা তথ্য দিলে ও বিরক্তিকর কলে শাস্তির বিধান : বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০১ সংশোধনী জুলাই ২০২১ এ ৯৯৯ নম্বরে বিরক্তিকর কল বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের জন্য এক লক্ষ টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রেখে মোবাইল কোর্টে বিচারযোগ্য অপরাধ হিসেবে তফশিলভুক্ত করা হয়েছে।

৯৯৯এ ডিউটিরত সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ সদস্য জানান, জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯এ অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে খুব সামান্য ঘটনায়ও ফোন আসে। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে কিছুই পায় না। আবার অনেক সময় কোন স্থান থেকে ফোন দেয় তা না বলেই কেটে দেয়। কেউ কেউ কল করে অ্যাম্বুলেন্স সেবা চায়। অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর পর কলারের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তখন অ্যাম্বুলেন্স চালককে তেল পুড়িয়ে আবার ফেরত আসতে হয়। তারা আরও বলেন, এখানে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কল করে। পরে বলে ভুলে কল গেছে। আবার মামলা কোর্টে অথচ অনেকে ৯৯৯এ কল করে তথ্য জানতে চায়। তাকে যতই বলা হয় এটা কোর্টের বিষয়, এ বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করতে পারব না, কলার তারপরও বারবার কল করে বিরক্ত করতে থাকে। এভাবে নানা ধরনের বিব্রতকর ঘটনাও ঘটে। তবে যথাসম্ভব সব কলের সেবা দিতে প্রস্তুত থাকি আমরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমালয়েশিয়ায় ৮৫ বাংলাদেশি অভিবাসী আটক
পরবর্তী নিবন্ধআইসিইউ’র জন্য হাহাকার এবার কমবে