বিদায়, হে সাহসিনী

রিতু পারভী | শনিবার , ২৫ মার্চ, ২০২৩ at ৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষ হিসেবে নারীর অবস্থান নিয়ে ভাবছিলাম কিছু লেখার জন্য। বার বার ভয়, শংকা নিয়ে অপূর্ণ এক মানুষের ছবি তৈরি হচ্ছিল। নিজেকে পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে অহর্ণিশ যুদ্ধ করে যাওয়া মানুষটির নাম ‘নারী’। লিখব বলে যখন প্রস্তুত হলাম তখনই সংবাদটা সামনে এলো। ভাস্কর শামীম শিকদার আর নেই।

 

শামীম সিকদার সেই সাহসিনী যিনি ভয়, শংকা, দ্বিধাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিজের মত করে একটা জীবন যাপন করে গেছেন। শামীম সিকদারকে আমার লিভিং মিথ মনে হতো, না মিথ হওয়ার মতো মানুষ তিনি হয়তো নন অথবা হয়তো তিনি তাই। দুরু দুরু বুকে দিন পার করা প্রতিটি নারীর কাছে উনাকে ভিন গ্রহের মানুষ মনে হলে তা মোটেও অমূলক নয়। কী ভীষণ নিজের ইচ্ছেয় বাঁচা!

শামীম সিকদার’ নামটা প্রথম যে ধাক্কাটা দেয় সেটা হলো উনার সাহস। এই সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের মত বাঁচতে পারা সহজ নয়। এর জন্য নিয়ত লড়াই করার শক্তি থাকতে হয়। কে কী বলছে তা উপেক্ষা করার সাহস থাকতে হয়। একজন গুণী ভাস্কর হওয়া সত্ত্বেও শামীম সিকদার বলতে নিজের

মত বাঁচতে চাওয়া এক স্বাধীন সত্তার পরিচয়টাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সবসময়। কারণ জীবনকে এইভাবে যাপন করা সহজ কোন কাজ না।

২২ অক্টোবর ১৯৫২ সালে বগুড়ার মহাস্থানগড়ের চিংগাশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী শামীম সিকদারের ভাস্কর্য নিয়ে পড়াশোনা শুরু হয় বুলবুল ললিতকলা

একাডেমি থেকে। ফ্রান্সের এক ভাস্কর শিল্পীর কাছে তাঁর ভাস্কর্যের হাতেখড়ি। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে পরিণত ভাস্কর হিসেবে তৈরি করেন। লন্ডন, চীন থেকে নিজেকে প্রশিক্ষিত করেন এবং পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন। তিনি সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

একজন ভাস্কর হিসেবে শামীম সিকদার করে গেছেন অসংখ্য কাজ। যে দেশের নারীরা গৃহের নিরাপদ ছায়ার বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারে না সেদেশে কোন নারীর পক্ষে ভাস্কর হওয়ার কথা চিন্তা করাও এক বিপ্লব। সেক্ষেত্রে এদেশের আরেক গুণী সন্তান ভাস্কর নভেরা আহমেদ কিছুটা পথ হয়তো

দেখিয়ে গেছেন, দিয়েছেন লড়াই করার সাহস। ভাস্কর হতে গেলে উন্মুক্ত জায়গায়, শারীরিক শ্রম দিয়ে, সামাজিক অবস্থার বিপরীতে কাজ করার জন্য একজন নারীকে অত্যন্ত বলিষ্ঠ মনোবলের অধিকারী হওয়া জরুরি। ভাস্কর নভেরার মত শামীম সিকদারও ছিলেন তেমনি বিপ্লবী এক নারী।

ভাস্কর হিসেবে কতখানি জনপ্রিয় সে মাপকাঠিতে যাওয়া নিতান্তই অবান্তর, তিনি যে কাজ করেছেন তা অনেকের জন্য ঈর্ষণীয়। এক ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ই ভাস্কর শামীম সিকদারকে চিরকাল মনে রাখার মত কাজ। ১৯৮৮ সালে ঢাকার টিএসসিতে স্থাপিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’র মূল বেদীতে আমাদের স্বাধীনতার

বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত আছে। আছে মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত ভাস্কর্য। ফুলার রোড সংলগ্ন, উদয়ন স্কুলের উল্টো পাশে অবস্থিত ‘স্বাধীনতা চত্বরে’ শামীম সিকদার তৈরি করেছেন অসংখ্য ভাস্কর্য। যদিও অযত্ন, অবহেলায় এই শিল্পকর্মগুলো নষ্ট হচ্ছে। জগন্নাথ হলে বিবেকানন্দের ভাস্কর্য,

এফডিসিতে নজরুলের ভাস্কর্য সবগুলো শামীম সিকদারকে মনে করাবে, পরিচিত করাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।

তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন সময়ে শামীম সিকদার অর্জন করেছেন নানা সম্মাননা। ২০০০ সালে একুশে পদক অর্জনকারী এই ভাস্কর তাঁর নিজস্ব পরিচয়েয় পরিচিত হয়েছেন, উদ্ভাসিত হয়েছেন স্বমহিমায়। অন্য কোন পরিচয়ের তাঁর দরকার হয় কী! ইতিহাস তাঁর পরিচয়েই হয়তো পরিচিত করাবে অন্য

কাউকে।

এই নারী সাহসিনী ২১ মার্চ ২০২৩ সকল আলোচনার ইতি টেনে চলে গেছেন অজানা গন্তব্যে।