শুক্রবার বাদে জুমা। নগরের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ মাঠ; কানায় কানায় পূর্ণ। উপস্থিত শোকার্ত হাজার হাজার মানুষ। সবার সামনে কফিনবন্দি আবদুল্লাহ আল নোমান। কিছুক্ষণ পর শুরু হবে জানাজা। এরপর নেয়া হবে রাউজান, চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে যেখানে। ঠিক এসময়ে যদি কিছু বলার সুযোগ পেতেন জনমানুষের এ নেতা, তাহলে কী বলতেন তিনি? যদি বিদায়ী ভাষণ দেয়ার সুযোগ দেয়া হত, তাহলে হাজার হাজার মানুষকে কী বলতেন নোমান?
জানাজার আগে বক্তব্য রাখেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদের পুত্র সাঈদ আল নোমান তূর্য। বাবার শেষ বক্তব্যই প্রতিধ্বনি হল তার কণ্ঠে। আবেগ ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বক্তব্য রাখেন তূর্য। তার বক্তব্য শুনে চোখ মুছেন জানাজায় অংশ নেয়া অনেকেই।
সাঈদ আল নোমান তূর্য বলেন, আমার বাবার রাজনৈতিক জীবন ৬৮ বছরের। আমার এই জীবনে যত মানুষের সাথে আমার দেখা হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ কখনো না কখনো বলেছেন– ‘আমি নোমান ভাইয়ের দ্বারা কোনো না কোনো উপকার পেয়েছি আমার জীবনে’। কীভাবে সম্ভব তা জানি না! মাত্র ২ বার তিনি মন্ত্রী ছিলেন। এত স্বল্প সময়ে এত মানুষের কাজ কীভাবে করেছেন, আমি জানি না।
সাঈদ আল নোমান বলেন, আমি ভাবছি, আজ যদি তিনি (নোমান) জানতেন, এটা তার শেষ বিদায়ী ভাষণ, যদি তিনি সেভাবে বুঝতেন, তাহলে আপনাদের তিনি কি বলতেন। আমি পাশে থাকতাম, তাই আমি জানি তিনি (নোমান) বলতেন, ‘অ্যাই (আমি) নোমান, আবদুল্লাহ আল নোমান, ক্যান আছো? (কেমন আছো?) আমার সাথে মন খারাপ করেছ?’ কেউ যদি মন খারাপ করত, কীভাবে যেন বুঝে যেতেন। বলতেন, ‘নিশ্চয় আমার কোনো দোষ ছিল, না হলে আমার উপর কেন মন খারাপ করল’। অথচ তার (নোমান) যে মন খারাপ সেটা বলতেন না। কাউকে কোনোদিন বলেননি, ‘আমার তোমার উপর মন খারাপ’। বলতেন, ‘তোমার বোধহয় আমার উপর মন খারাপ’।
সাঈদ আল নোমান বলেন, শেষ বিদায়ী ভাষণ জানলে বাবা বলতেন, ‘বহু বছর ধরে আমি তোমাদের সাথে কাজ করি, আমার যদি ভুলত্রুটি হয়, আমি তো আজকে চলে যাচ্ছি, আজকের পর থেকে তোমাদের চোখে চোখ রাখতে পারব না, অভিমান জানাতে পারব না, তোমাদের অভিমান শুনতে পারব না, ক্ষমা করে দিও’। বলতেন, ‘আমার অল্প সময়ে ভেটেরিনারী ইউনিভার্সিটি করেছি, যেটা এখন পৃথিবীতে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়।’ বলতেন, ‘চেষ্টা করেছি, কীভাবে কীভাবে যেন হয়ে গেছে’। কারণ কখনো তিনি নিজের ক্রেডিট ওভাবে নিতেন না।
সাঈদ আল নোমান বলেন, বাবা শেষ বিদায়ী ভাষণে বলতেন, ‘বাকলিয়ায় শীহদ এন এম এম জে কলেজ করেছি, খুব নিরবে করেছি। সেই কলেজে যেন কোনো অ্যাটাক না আসে, ষড়যন্ত্র না হয়। এটার তো উন্নতি করতে হবে, তোমাদের কাছে রেখে গেলাম। মনে রেখ ৯০ আমাদের জীবনে খুউব গুরুত্বপূর্ণ। ৭১, ২০ এবং ২৪, তারা আগে তো ১৯৫২’।
আবার শেষ ভাষণে বলতেন (নোমান বলতেন), ‘১৯৬৩ খিস্ট্রাব্দে যখন ছাত্র ইউনিয়ন করি, আমি অনেকের মতই অথবা প্রথম লালদীঘি ময়দানে বলেছিলাম, আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় দরকার চট্টগ্রামে। আজকে আমরা সেই বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি। আমাদের কত ভালো লাগা, আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমাদের কুয়েত ফান্ড ছিল। দেশনেত্রীকে বললাম, ম্যাডাম আপনার মুখ দিয়েই তো প্রচার করিয়ে দিলাম, তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু হবে। এখন কি হবে। তো পাশ করে এই তৃতীয় সেতু আমরা করে ফেলেছি। এই সেতু আজও আমাদের গর্ব। অন্য কোনো সেতু বা টানেল নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কাজ হচ্ছে এই সেতু। আমি ৯০ এর দশকে কিছু মুরুব্বির সাথে যোগাযোগ করে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড করতে পেরেছি।’
সাঈদ আল নোমান বলেন, জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ। এই মসজিদকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। বরাদ্দ এনেছিলেন।
তূর্য বলেন, তিনি ( নোমান) বলতেন, ‘আমরা সবাই চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলি। অনেকে বলে বাণিজ্যিক রাজধানী হয়নি। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আবদুল্লাহ আল নোমানের প্রস্তাবনায় অফিসিয়ালি চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন ১৬ দফা দিয়ে। আমরা কেন এভাবে বলি না, বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। কেন প্রত্যেকটা সরকারকে বলি না, আপনারা ১৬ দফা পড়ে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীর গুরুত্বে নিয়ে যান। এখানে মন্ত্রিসভার কাজটা করেন।’ তিনি (নোমান) বলতেন, ‘আমি ১৬ দফায় শেষ করেছি, আরো ৩২ দফা হওয়া দরকার।’
সাইদ আল নোমান বলেন, অনেক কাজ তিনি করেছেন। কিছু মৌলিক কাজ আপনাদের জানালাম। স্টেডিয়ামের আধুনিকায়নও তার হাতে হয়েছে।
নোমানপুত্র বলেন, শেষ বিদায়ী ভাষণে তিনি ( নোমান) বলতেন, আমার দুইজন সন্তান রেখে গেলাম। আমি আশা করব এই সন্তানের মাধ্যমে কেবল সেবা হবে, অন্য কিছু হবে না। আর কোনো চাওয়া নেই।’ আপনারা সবাই উনার জন্য দোয়া করবেন।
এর আগে সকালে নাসিমন ভবন দলীয় কার্যালয় নোমানের মরদেহের সামনে শত শত নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে বক্তব্য রাখেন সাঈদ আল নোমান। এসময় তিনি বলেন, আপনাদের আর কোনো অভিমান আর তার কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। রাজনীতিতে অনেক প্রতিযোগিতা ছিল, সেই প্রতিযোগিতাও আর আপনারা আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে করতে পারবেন না। তার নিজেরও কোনো দু:খ, কোনো অভিমান যদি থাকে, সেটা আর আপনারা জানতে পারবেন না। আমি এক অসহ্য তাড়নায় ডুবে আছি। কী করতে পেরেছি সন্তান হিসেবে তার জন্য। আমি আজ এখানে লিখে দিতে পারবো, আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি, আপনারাও আজ নিজেকে প্রশ্ন করুন। আপনাদের যাদের সঙ্গে তার দীর্ঘ পরিচয় ছিল, আপনারা নিজেকে প্রশ্ন করুন– নোমান ভাইয়ের জন্য আমি কী করতে পেরেছি আর নোমান ভাই আমার জন্য কী করেছিলেন। আমি সন্তান হয়ে যদি এই প্রশ্নের মধ্যে পড়ি, আপনারাও তার সন্তান, কখনো কখনো আপনারা আমার চেয়েও তার বেশি প্রিয় সন্তান ছিলেন। রাজনৈতিক শিষ্যের জায়গা থেকে, রাজনৈতিক সহকর্মীর জায়গা থেকে, রাজনৈতিক সহযোদ্ধার জায়গা থেকে, সন্তান ছিলেন আপনারাই।
সাঈদ আল নোমান বলেন, যদি মানুষের জন্য কিছু করতে হয়, সর্বোত্তম পন্থা রাজনীতি। আবদুল্লাহ আল নোমানকে সৃষ্টি করেছিল মানুষ। আজ যিনি শুয়ে আছেন, তিনি যেমন অসাধারণ একজন রাজনীতিবিদ, তেমনি একজন অসাধারণ মানুষ। একজন ব্যক্তি আবদুল্লাহ আল নোমান তাই সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে, এমপির ঊর্ধ্বে, মন্ত্রীর ঊর্ধ্বে একজন মানুষ, যার জন্য পুরো চট্টগ্রাম, পুরো দেশ কাঁদছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ব্যক্তিচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে কেউ যদি প্রতিষ্ঠানকে সার্বজনীন করার চিন্তা করেন, সেটা একজনই আবদুল্লাহ আল নোমান। সেজন্য অসংখ্য অসামপ্রদায়িক সংগঠনের লোকজন, যাদের কথা অন্য কেউ চিন্তাও করতে পারবে না, উনার মৃত্যুর পর থেকে এমন হাজার হাজার মানুষ উনাকে একনজর দেখার জন্য এসেছেন। রাজনীতিতে অপরপক্ষ থাকে, দলের ভেতরও থাকে, বাইরে তো অবশ্যই থাকে। কিন্তু আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুর পর গত তিনদিন ধরে যদি সোশ্যাল মিডিয়া ফলো করেন, দেখবেন, লাখো মানুষ, যিনি যে দলই করুক না কেন উনার জন্য একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এমন উদাহরণ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির নেই। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে বলছি, চট্টগ্রামের ইতিহাসে নয়।