১.
ডিসেম্বর এলেই শুরু হয়ে যায় পরিচ্ছন্নতা অভিযান। স্মৃতিসৌধের আশপাশে বছর জুড়ে জমে থাকা ধুলো-ময়লা, আবর্জনা সরিয়ে নিয়ন বাতিতে সাজাতে হবে। বিজয় মঞ্চ ও তোরণ নির্মাণ করতে হবে দেশজুড়ে- শত শত হাজার হাজার। আবর্জনা সরানোয় আর মঞ্চ ও তোরণ নির্মাণে নিয়োজিত শ’য়ে শ’য়ে হাড় জিরজিরে মানুষ, যাদের জীবনে বিজয় দেখা দেয় না কোনকালে। ওরা জানে না স্বাধীনতার মানে কি। একই চিত্র দেখা যায় ফেব্রুয়ারি আর মার্চ এলে। উৎসবের আয়োজনে-আয়োজনে বছর ফুরোয়।
অর্ধ শতক আগে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দেন, তখন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কৃষক, শ্রমিক, মজুর, যুবা- সবাই যুদ্ধে নেমেছিল। বাংলার প্রতিটি ঘর হয়ে উঠেছিল একেকটি দুর্গ। মহাসমারোহে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন শেষে সেই দুর্গগুলোতে বিজয় ও স্বাধীনতার বাণী পৌঁছাল কি না, স্বাধীনতার স্বাদ গন্ধ পাওয়া যায় কি না, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি?
লাল-সবুজ পোশাক অঙ্গে জড়িয়ে আমরা সুদৃশ্য মঞ্চে আরোহণ করে প্রমিত ভাষায় সুন্দর আর অতি মূল্যবান বক্তব্য উপস্থাপন করব, প্রশংসার বন্যায় ভেসে যাব, ইতিহাস সৃষ্টি করব। কিন্তু মঞ্চ তৈরি করে দেওয়ার জন্য অগ্রহায়নের হিমশীতল রাতগুলো জেগে, ঘাম ঝরিয়ে, কাজ করে যায় যারা, তাদের কি ডেকে নেব আলো ঝলমলে মঞ্চে? যদি না-ই ডাকি, যদি ওদের কাছে না-ই টানি তাহলে কেন এই বিজয়? এ কেমন স্বাধীনতা? স্বাধীনতা কি কেবলই পরিপাটি পোশাকের বিশিষ্ট মানুষদের জন্য? নজরুলের কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত না হলে সে স্বাধীনতা অর্থহীন।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের পটভূমি নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন ছায়াছবিতে দেখানো হয় দেশীয় কর্মচারী ও নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী জনগণকে মানুষ বলে গণ্য করত না ইংরেজ সাহেবসুবারা। চট্টগ্রামস্থ ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে বড় করে লেখা ছিল- ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। দুই দফায় স্বাধীনতা এসেছিল বাঙালির ললাটে। ব্রিটিশ খেদালেও নতুন প্রভুর আসনে বসে যায় পাকিস্তানী অপশক্তি। তাদেরও তাড়ানো হয়। বাংলা অবশেষে বাঙালির হয়। কত না দাম দিয়ে কেনা এই বাংলা! মাটির মানুষদের ঠাঁই কোথায় আমাদের এই প্রাণের বাংলায়?
২.
রথিন্দ্রনাথ রায়ের একটা গান ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল- ‘ছোটদের বড়দের সকলের, গরিবের নিঃস্বের ফকিরের আমার দেশ সব মানুষের …।’ সত্যিই কি আমার দেশটা সব মানুষের? কালে-কালে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গিয়েছে। এগিয়েছে আমাদের স্বদেশও। মানুষের জীবনযাত্রার মানের দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। কিছু মানুষ কিংবা বলা যায় অনেক মানুষের জীবনধারা পাল্টে গিয়েছে। কেবল দুর্বলের ওপর সবলের ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ হয়নি।
অর্থনীতির চাকা ঘুরছে সমাজের নীচতলায় বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষদের ঘাম, রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করে যাচ্ছে উঁচু তলার বাসিন্দারা। সূচকের ঊর্ধ্বগতি বলে দেয় ক্ষুধা দারিদ্র অতীত হয়ে গিয়েছে বাংলার বুক থেকে। নামীদামী সুধীজনেরা সভা সমিতিতে প্রায়শই উচ্চারণ করে থাকেন- তাঁদের ছেলেবেলায় ভর দুপুরে কিংবা পড়ন্ত সন্ধ্যায় অভুক্ত মানুষেরা ভিড় জমাত ঘরের দাওয়ায় কিংবা বাড়ির আঙিনায়; এখন তেমনটি দেখা যায় না। সুতরাং একথা নিশ্চিত- দেশে ক্ষুধার্ত মানুষ নেই, একটিও।
সুধী ব্যক্তিগণ বোধ হয় ভুলেই গিয়েছেন যে, ছেলেবেলায় খোলামেলা বাড়িতে বসবাস করলেও এখন তাঁদের বাস পাঁচিল ঘেরা বৃহৎ অট্টালিকায়। প্রধান ফটকে উর্দিধারী দ্বাররক্ষী দণ্ডায়মান দিবারাত্র। পরিপাটি পোশাকে কোন অচেনা অতিথি এলেও তাঁকে ঠিকুজি পেশ করতে হয়। মালিকের অনুমতি পেলেই কেবল দ্বার খোলা হয় এবং ভেতরে প্রবেশের অধিকার দেওয়া হয় সেই অতিথিকে। এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ক্ষুধার্ত মানব সন্তান সুধীজনের বাড়িতে খাবার চাইতে যাবে কি করে? কোন সাহসে?
আজকাল আবার অনেক অভিজাত আবাসিক এলাকা, বিপণী ও রেস্তোরাঁর ফটকে লেখা থাকে- ‘ভিক্ষুক ও হকারমুক্ত এলাকা’। সুবেশী নর-নারী শিশু তরুণ যুবা সুখি সুখি চেহারা নিয়ে ঝলমলে বিপনিতে কেনাকাটা করতে যায়, দামী রেস্তোরাঁয় খেতে যায়। ভিখিরিরা ঝামেলা করলে কেমন লাগে! দুটো ফুটো পয়সা ছুঁড়ে দিলেও নিষ্কৃতি মেলে না। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে পঙ্গপালের মতো। আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার যাত্রাপথে এমন অপয়াদের মুখ দেখতে নেই! তাইতো ওদের চলাফেরার সীমানা এঁকে দেই আমরা।
৩.
বছর দুয়েক আগে বিজয় দিবসের আগের সন্ধ্যায় চমকে ওঠার মতো খবর- আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত সর্বাধিক প্রশংসা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেওয়া চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’র মূল ভূমিকা রূপায়নকারী শিশুশিল্পী (এখন পূর্ণবয়স্ক) কামরাঙ্গিচরে পান চায়ের দোকান চালায়। ‘আনু’র ভূমিকায় নুরুল ইসলামের অনবদ্য অভিনয়কে অভিনয় বলে মনে হয়নি। এটা নিশ্চয় প্রথিতযশা নির্মাতা তারেক মাসুদের নৈপুণ্য। কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে কর্মরত শিশু গৃহকর্মীকে মহৎ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাকে দিয়ে জাতশিল্পীর মতো কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়াত পরিচালকের সাধুবাদ পাওনা।
কিন্তু হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান নুরুল ইসলাম দেশকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেওয়া চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণের জন্য কোন পারিশ্রমিক পায়নি- এমন কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তাতে কি? জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তো পেয়েছে সে! অতঃপর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই শিশু পরিচালকের বাড়িতেই বহাল হয় গৃহকর্মী হিসেবে। এমন ক্ষুদ্র একজন মানুষের শিক্ষা কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার সময় আর কারও হয়নি। নানান ঘাঁটে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে, ভাগ্যের হাতে বারে বারে প্রতারিত হয়ে অবশেষে পান-চায়ের দোকান নিয়েই থিতু হন নুরুল ইসলাম। সমাজবিরোধী কোন কাজে জড়িয়ে পড়েনি, ভাগ্য বলতে হয়। ইতোমধ্যে কেটে গেছে কুড়িটি বছর। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে এই জীবনযুদ্ধে হাসি লেগে আছে মুখে, সততার হাসি। কেবল ‘মাটির ময়না’র কথা উঠতেই মিলিয়ে যায় সে হাসি।
এমনি করে দিনহীনদের মুখের হাসি মুছে দিয়ে কেবলই সমাজের ওপরতলার মানুষরা হাসি-আনন্দে জীবন ভরিয়ে তুলবে, সকল জাতীয় দিবসে রঙ মিলিয়ে পোশাক পরে উদযাপনের বাঁধভাঙা উল্লাসে সামিল হবে, চেতনার গালভরা বুলি আওড়াবে- এমন স্বাধীনতার জন্যই কি প্রাণ দিয়েছিলেন লক্ষ মুক্তিসেনা? তাঁদের আত্মাহুতির প্রতিদান কি আমরা আজও দেব না? স্বপ্নের সেই বিজয় ফুলের দেখা পেতে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে বাঙালিকে ?