বাংলাদেশের বিজ্ঞানচর্চাকে যিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি অধ্যাপক ডক্টর জামাল নজরুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বিজ্ঞানীর কারণে বাঙালির সমাদর ও মর্যাদা বিশ্বভুবনে বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে বাবার কর্মস্থলে বাঙালির গর্বের ধন জামাল নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে কলকাতায়, পরে চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র ক্যামব্রিজ, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স, প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন। এরপর ‘ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্বের অনেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন: যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড, ক্যামব্রিজ ইন্সটিটিউট, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট, লন্ডনের কিংস কলেজ, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়, মনের সিটি ইউনিভার্সিটি প্রভৃতিতে তিনি অধ্যাপনা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ক্যামব্রিজ থেকে ড. জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণা গ্রন্থ ‘দ্যা আল্টিমেট ফেইট অব দ্যা ইউনিভার্স’ প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে হইচই পড়ে যায় এবং বইটি দ্রুত পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হতে থাকে। সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ কখনো এক সরলরেখায় মিলিত হলে পৃথিবী ধ্বংস হবে বলে যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো তা থেকে বিশ্ববাসীকে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী। গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন-সে রকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ছাত্রজীবনে তার সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আরেক বিস্ময়কর বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। ভারতের বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর, পাকিস্তানের আবদুস সালাম, নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ফ্রিম্যান ডাইসন, রিচার্ড ফাইনম্যান, অমিয় বাগচি, জয়ন্ত নায়নিকার, জিম মার্লিস প্রমুখ বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীরা ছিলেন তাঁর বন্ধু ও গবেষণার সহযাত্রী।
৩০ বছর ধরে উন্নত বিশ্বের দামি চাকরি, রাজকীয় ও লোভনীয় জীবনের মায়া কাটিয়ে ১৯৮৪ সালে জামাল নজরুল ইসলাম সপরিবারে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে-নিজ জেলা চট্টগ্রামে। স্বল্প বেতনে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। সেখানে তিনি গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার ‘গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’। যেখানে পদধূলি দিয়েছেন পৃথিবীর অনেক খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, নোবেল বিজয়ী, আপেক্ষিক তত্ত্ববিদ। তাঁরা এ প্রতিষ্ঠানকে জামাল নজরুলের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য আরো বই হচ্ছে “রোটেইনিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি” এবং “এন ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি”। বাংলায় লিখেছেন “কৃষ্ণ বিবর”, “মাতৃভাষা ও বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ”, “শিল্প, সাহিত্য ও সমাজ”, বাংলা একাডেমি থেকে “ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা” নামে চমৎকার একটি সিরিজ প্রকাশিত হয়। এই সরল বিশ্বাসপ্রবণ মানবতাবাদী বিজ্ঞানীর একটি সরস মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেশের বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন তাঁর একটি নিবন্ধে লিখেছেন-“বিজ্ঞান গবেষণার বাইরেও চট্টগ্রামের নানা সংস্থা ও উদ্যোগে জড়িয়ে পড়েন জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁর মূল্যবান সময়ের অনেকখানিই এভাবে ব্যয়িত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাঁকে চিন্তিত রাখত। সমাজে হিংসা ও হানাহানি, ক্ষমতাবানের দৌরাত্ম্য, চরমপন্থা ও অসহিষ্ণুতার প্রকোপ তাঁকে খুবই কষ্ট দিত। মানুষের মধ্যে লোভ আর স্বার্থপরতা দেখলেও তিনি খুব মন:কষ্টে ভুগতেন। উন্নয়নের নামে প্রকৃতি, পরিবেশ ও গরিবের স্বার্থবিরোধী কাজ দেখলে তিনি হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘পরিত্রাণকর্তা আসবেন, দারিদ্র্য লাঞ্চিত কুটির থেকে পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে”।
অধ্যাপক জামাল নজরুলের মা রাহাত আরা বেগম ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী লেখক, গানও গাইতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকটি উর্দূতে অনুবাদ করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। এই মানবদরদী বিজ্ঞানীর অকৃত্রিম বন্ধু অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশিদ ও ‘ইতিহাস ইমেরিটাস’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আবদুল করিমের প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়। দেশের অনেক কৃতী ছাত্রছাত্রী এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে পিএইচডি করে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছেন।
দেশের জন্য, দেশের বিজ্ঞান চর্চার জন্য জামাল নজরুল ইসলাম যে পরিমাণ ত্যাগ ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তা নজিরবিহীন। নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই গণিত ও ভৌত বিজ্ঞানী ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে চট্টগ্রামে ইন্তেকাল করেন। এরকম একজন জামাল নজরুল ইসলামকে পেতে আমাদের হয়ত আরো শত শত বছর অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্বের বুকে বাঙালির গর্ব এই কীর্তিমান মহান বিজ্ঞানী, আলোকিত বাঙালি নক্ষত্র প্রফেসর ডক্টর জামাল নজরুল ইসলামকে তাঁর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক, আয়কর পেশাজীবী।