‘নামে কী আসে যায়’–এটি শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত ট্রেজেডি নাটক ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’ এ উদ্ধৃত এবং সাধারণে বহুল ব্যবহৃত উক্তি। তা অলংকারিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শেক্সপিয়ারের অনবদ্য সৃষ্টি রোমিও এন্ড জুলিয়েট ইটালীর ভেরোনা শহরের দুই অল্পবয়সীর প্রেমের উপখ্যান, যারা দু’জন দুই বিবাদমান পরিবারের সদস্য। রোমিও মন্টেগু এর সাথে জুলিয়েট কাপুলেট এর মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রোমিওর নামের শেষ অংশ অর্থাৎ মন্টেগু, যা তাদের পারিবারিক নাম এবং জুলিয়েট এর নামের শেষ অংশ কেপুলেট, যা জুলিয়েটের পারিবারিক নাম। মন্টেগু আর কেপুলেট পরিবারের বিরোধ দীর্ঘদিনের। তবে শেষ পর্যন্ত নাম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তাদের পরিণয়ে। তাই শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘নামে কী আসে যায়’, যা যুগ যুগ ধরে মানব সমাজে উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে নামে কিছু না এসে গেলেও মানুষ নবজাতকের সুন্দর ও ব্যতিক্রমধর্মী নাম দিতে সদা সচেষ্ট থাকে। নবজাতকের সুন্দর তাৎপর্যমণ্ডিত নামকরণের জন্য কেউ কেউ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরণাপন্ন হতেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমত্য সেনের নাম একইভাবে উনার দেওয়া। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষের নামের তেমন কোন বিশেষত্ব থাকে না। অথাৎ ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ও হতে দেখা যায়। ‘নাম মানুষকে বড় করে না মানুষই নামকে ঝাকাইয়া তোলে’–এই বচনের সার্থকতা দানে সচেষ্ট হয় সবাই।
মানুষের নামকরণের কোনও নিয়ম না থাকলেও মানবদেহের অসুখের ক্ষেত্রে এই নামাকরণ কিছু নিয়ম মেনে চলে। অনেক ক্ষেত্রে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত নির্দেশনা মেনে হয়ে থাকে। কোন শারীরিক অসুখের নাম হতে পারে তার আবিষ্কারকের নামে যেমন স্নায়ুবিক রোগ ‘পারকিনসন্স ডিজিস’ তার আবিষ্কারক জেমস পারকিনসন্স এর নামে। কোন কোন রোগের নাম হয়ে থাকে সে রোগে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তির নামানুসারে। যেমন স্মৃতি বিলোপ পাওয়া রোগ ‘আলজিমার্স ডিজিস’। আবার তা হতে পারে প্রথম সনাক্ত হওয়া ভৌগলিক স্থানের নামে। যেমন ‘স্পনিশ ফ্লু’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পর ১৯১৮ সালে তা স্পেনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এতে স্পেনের তৎকালীন রাজা আলফোনসো নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে অধিকাংশ রোগের নাম সেই রোগের শারীরিক উপসর্গ অনুসারে হয়ে থাকে। কোভিড তার উৎকৃষ্ঠ উদাহরণ। তা শ্বাসতন্ত্রকে তীব্রভাবে সংক্রমণ করে বলে তার নাম ‘একিউট রেসপিরেটরী ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম’। হৃদরোগ, কিডনী রোগ, স্ট্রোকের নামকরণও এই নিয়মে।
তবে ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সম্প্রতি আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করা এই রোগ দুটোর মধ্যে চিকুনগুনিয়া বর্তমানে চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তা ক্ষেত্র বিশেষে ইতিপূর্বে বিস্তার লাভ করা ডেঙ্গু (মতান্তরে ডিঙ্গি) কেও ছড়িয়ে গেছে।
চিকুনগুনিয়া নামেও রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রথম শুনে মনে হতে পারে তার উৎপত্তি বাংলা ভাষাবাসী কোনও স্থানে। ধ্বনি বিকৃতিতে তা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় চিকন গুইন্যাও হতে দেখা যায় কিন্তু আসলে তা নয়। তার উৎপত্তি পূর্ব আফ্রিকার তাঞ্জানিয়া ও মোজাম্বিকের মাকোন্ডে মালভূমিতে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাষা মাকোন্ডে। এই ভাষায় এই রোগকে প্রথম চিকুনগুনিয়া নামকরণ করা হয়। ১৯৫২ সালে এই অঞ্চলে এই রোগের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই ভাষায় চিকুনগুনিয়া শব্দের আক্ষরিক অর্থ বিকৃত হওয়া। ঘাড় বাকা করে মাথা নুঁইয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটা। চিকুনগুনিয়া রোগের প্রধান উপসর্গ শরীরের তীব্র ব্যথা। ব্যথার তীব্রতায় আক্রান্ত ব্যক্তির শারীরিক বিকৃতির জন্য এই নামাকরণ। চিকুনগুনিয়া নামের উৎপত্তির এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থাকলেও ডেঙ্গু শব্দের উৎপত্তি অনেকটা অনিশ্চিত। এটা সম্ভবত পূর্ব আফ্রিকার আধিবাসী জনগোষ্ঠী প্রথম ব্যবহার করে। তা আফ্রিকা থেকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হয়ে স্পেনে এসে ডেঙ্গুর নাম ধারণ করে। স্পনিশ ভাষায় তার অর্থ সন্তর্পণে হাঁটা যা ব্যথার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্তর্পণে হাঁটাকে নির্দেশ করে। ১৮০১ সালে স্পেনের তৎকালীন রানি লুইসা তার লেখা এক পত্রে তিনি যে রোগে আক্রান্ত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছিলেন তাই ডেঙ্গু। নামের বৈচিত্রে ডেঙ্গুও কম যায় না। ধ্বনিগতভাবে তা ডিঙ্গির মতো শোনায়। তাই মনে হতে পারে তা বাংলা ভাষা জাত শব্দ।
নাম ও উপসর্গের ভিন্নতা সত্ত্বেও চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর কারণগত সাদৃশ্য বিদ্যামান। নামের বৈচিত্রেও রয়েছে একধরনের সাদৃশ্য। তবে এই রোগ দুটোর মধ্যে বৈসাদৃশ্যও বিদ্যমান। চিকুনগুনিয়া শরীরের অস্থিসন্ধি ও মাংশপেশীকে বেশি আক্রান্ত করে। তাই প্রচণ্ড ব্যথাই তার প্রধান উপসগর্, সাথে শরীরের বিভিন্ন অংশ, বিশেষত পায়ের নিচের অংশ ফুলে যায়। অন্যদিকে ডেঙ্গু রক্তের অনুচক্রিকাকেই বেশি আক্রান্ত করে। তার প্রধান উপসর্গ অনুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস ও তার কারণে চামড়ার র্যাশ ও শরীরের রক্তক্ষরণ। তবে চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু উভয়ই জটিলতা হিসাবে হৃদযন্ত্রকে বিভিন্নভাবে আক্রান্ত করতে পারে। হৃদযন্ত্রের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ সৃষ্টি করে তা হৃৎপেশীর দুর্বলতা ও হার্ট ফেইলিউরের উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। পক্ষান্তরে হৃদরোগীদের এই রোগ দুটো সংক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এবং আক্রান্ত হৃদরোগীর শারীরিক উপসর্গের দ্রুত অবনতি ঘটে। তাই এই সংক্রমণ থেকে রেহাই পেতে হৃদরোগীদের বাড়তি সর্তকর্তা আবশ্যক।
এই দুটো রোগের মধ্যে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হৃদরোগীরা পায়ের ব্যথার সাথে দ্রুত পা ফোলা নিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। এটা কি কেবল অস্থি সন্ধির সংক্রমণের কারণে নাকি হৃদরোগজনিত তা গবেষণার দাবি রাখে। তবে তা নিদিষ্ট সময়ান্তে সেরে উঠে।
হৃদরোগী বিশেষত হার্টের রক্তনালীতে স্টেন্ট বা রিং লাগানো হৃদরোগী যাদের উচ্চমাত্রায় রক্ত তরল রাখার ওষুধ (এসপিরিন শ্রেণির) সেবন করতে হয় তাদের ডেঙ্গুর আক্রমণে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। এই ওষুধ রক্তের অনুচক্রিকার কার্যক্ষমতা হ্রাস করে আবার ডেঙ্গু ভাইরাস অনুচক্রিকার সংখ্যা ও কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। তাই আক্রান্ত রোগীর রক্তক্ষরণের আশংকা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বাঞ্ছনীয়।
পরিশেষে, বৈচিত্র্যমণ্ডিত এই রোগ দুটোর উপসর্গও কিছুটা বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও প্রায়ক্ষেত্রে একটা নিদিষ্ট সময়ান্তে তা সেরে উঠে। তবে ডেঙ্গুর সংক্রমণজনিত শকে কখন কখনও মৃত্যু ঘটে রোগ দুটোই অনেক ক্ষেত্রে অসহনীয় ভোগান্তি সৃষ্টি করে। তাই জনস্বাস্থ্য সচেতনার মাধ্যমে তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা আবশ্যক।
লেখক: অধ্যাপক, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন।