বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে কোনো সংস্কার কার্যক্রম স্থায়িত্ব পাবে না

চবিতে একে খান আইন বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৫ মে, ২০২৫ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি অপরিহার্য বিষয়। যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন না হয়, কোনো সেক্টরের সংস্কার কার্যক্রমই স্থায়িত্ব পাবে না। বিচার বিভাগের সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে আরো বৃহত্তর সংস্কারের কাঠামো নির্মিত হতে পারে। বর্তমান সাংবিধানিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে বিচার বিভাগই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কার্যকর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একে খান অডিটোরিয়ামে ‘ন্যায়বিচারের ভবিষ্যৎ পুনঃকল্পনা’ শীর্ষক আইন বক্তৃতা২০২৫ অনুষ্ঠানে গেস্ট অব অনারের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আইন অনুষদ ও একে খান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত হয় সপ্তম একে খান মেমোরিয়াল আইন বক্তৃতা অনুষ্ঠান। প্রধান বিচারপতি বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্রমবিকাশ বিচারপ্রক্রিয়ায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে; যার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। তিনি বলেন, বিচারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রযুক্তিনির্ভর নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সক্ষমতার ওপর। প্রযুক্তিগত এই পরিবর্তনগুলোকে বাধা হিসেবে দেখলে চলবে না, সেগুলোকে উদ্ভাবনের অনুঘটক হিসেবেও বিবেচনা করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আধুনিক জীবনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে এবং বিচারব্যবস্থা এ পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। এখন অপরাধের প্রকৃতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে যেখানে অপরাধ হতো বাস্তব জগতে, এখন তা ক্রমে স্থানান্তরিত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের মতো ভার্চ্যুয়াল জগতে। তিনি বলেন, ডিজিটাল জগৎ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন করতে গিয়ে অনেক সময় মৌলিক অধিকার, বিশেষত মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের শঙ্কা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে এমন একটি পরিশীলিত ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা তৈরি করা, যা একদিকে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করবে, অন্যদিকে সাইবার অপরাধ, হয়রানি এবং গোপনীয়তার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করবে।

২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নিজের ঘোষিত বিচার বিভাগ সংস্কার রোডম্যাপ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন ও পদ্ধতিগত দক্ষতাএই তিনটি লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, এর অংশ হিসেবে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার হস্তক্ষেপ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা দুটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও অপসারণের একমাত্র ক্ষমতা রাখে। বিচার বিভাগের পূর্ণ প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টের অধীন একটি আলাদা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্ন হয়েছে, যা সংস্কার অগ্রগতির মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করবে। সারা দেশে বিচারকদের বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে একটি বিস্তৃত বদলি ও পদায়নে নীতিমালা সরকারের কাছে ইতিমধ্যে পেশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করে সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, বিচারিক সংস্কার রোডম্যাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষায়িত বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা হলে বাণিজ্যিক বিরোধগুলোর দ্রুত ও কার্যকর সমাধান নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ সংস্কারে সহযোগিতা প্রদানে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এছাড়া ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সংবিধান ও গণতন্ত্রের মধ্যে সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে; যা অ্যারিস্টটলের ‘আইনের শাসন, ব্যক্তির শাসন নয়’ এই আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।

সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্‌ইয়া আখতার বলেন, এই আয়োজন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং সংবিধান কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে সংস্কারের চেতনা জাগ্রত করবে।

আইন বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. রকিবা নবি বলেন, সময়োপযোগী ও চিন্তন উদ্দীপক থিম আমাদের ন্যায়বিচার নিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. এম জাফর উল্লাহ তালুকদার। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপউপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. শামীম উদ্দিন খান, উপউপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন, একে খান ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সচিব সালাহউদ্দিন কাসেম খান এবং ট্রাস্টি এ এম জিয়াউদ্দিন খান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালদায় ভেসে উঠল মরা মা মাছ
পরবর্তী নিবন্ধসংবাদমাধ্যম যত বেশি প্রশ্ন করবে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা তত সচেতন হবেন : মাহফুজ আলম