বিএনপির সাত সংসদ সদস্যের মধ্যে পদত্যাগ করায় ছয়জনের আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে সংসদ সচিবালয়। ফলে আগামী মার্চের প্রথম ভাগের মধ্যে এই ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হবে। গতকাল সকালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর রাতেই এ গেজেট হলো।
ছয়জনের নাম (জাহিদুর রহমান, মো. মোশারফ হোসেন, জি এম সিরাজ, মো. আমিনুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার ভূঞা ও রুমিন ফারহানা) উল্লেখ করে আলাদা আলাদা গেজেটে বলা হয়েছে, ১১ ডিসেম্বর পূর্বাহ্নে পদত্যাগ করায় একাদশ সংসদের আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। শূন্য ঘোষিত আসনগুলো হচ্ছে ঠাকুরগাঁও–৩, বগুড়া–৪, বগুড়া–৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ–২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ ও এবং সংরক্ষিত নারী আসনের (মহিলা আসন–৫০)। মেয়াদপূর্তির এক বছর আগেই তারা সংসদ ছাড়লেন। ৯০ দিনের মধ্যে ওই আসনগুলোতে উপনির্বাচনের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ–৩ আসনে বিএনপির সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদের স্ক্যান করা সই ও ইমেইলে পাঠানো পদত্যাগপত্র ‘স্বাক্ষরযুক্ত’ বিবেচিত না হওয়ায় তাকে আবার জমা দিতে হবে। তিনি এক সপ্তাহ পর অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরে স্ব–স্বাক্ষরে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন বলে বিএনপির পদত্যাগীরা জানিয়েছেন। আসন শূন্য হওয়ার বিষয়ে সংবিধানের ৬৭(২) বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য স্পিকারের নিকট স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করতে পারবেন এবং স্পিকার কিংবা স্পিকারের পদ শূন্য থাকলে বা অন্য কোনো কারণে স্পিকার স্বীয় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ডেপুটি স্পিকার যখন উক্ত পত্র প্রাপ্ত হন, তখন হইতে উক্ত সদস্যের আসন শূন্য হবে।
সংবিধানের ১২৩ (৪) এ বলা হয়েছে, (৪) সংসদের কোনো সদস্যপদ শূন্য হলে পদটি শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত শূন্যপদ পূর্ণ করবার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকাল বিকালে জানিয়েছিলেন, আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ হলেই তারা উপনির্বাচনের প্রস্তুতি নেবেন। আসন শূন্য ঘোষণার গেজেট পেলে আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। পদত্যাগের গেজেট নোটিফিকেশনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ওইসব আসনে উপনির্বাচন হবে। এর আগে গতকাল সকালে স্পিকারের দপ্তরে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। তাদের মধ্যে পাঁচজন সশরীরে উপস্থিত থাকায় তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করেছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। বাকি দুজনের পদত্যাগপত্র যাচাই–বাছাই করে পরে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেন তিনি।
বিএনপির এমপিদের মধ্যে বগুড়া–৭ আসনের জি এম সিরাজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ–২ আসনের আমিনুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও–৩ এর জাহিদুর রহমান, বগুড়া–৪ আসনের মোশাররফ হোসেন এবং সংরক্ষিত নারী আসনের রুমিন ফারহানা স্পিকারের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন।
শনিবার গোলাপবাগের সমাবেশে তারা পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী গতকাল সশরীরে এসে সই করা পদত্যাগপত্র জমা দেন। মেয়াদপূর্তির এক বছর আগেই তারা সংসদ ছাড়লেন। এছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া–২ আসনের উকিল আব্দুস সাত্তার ‘অসুস্থতার’ কারণে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ–৩ এর হারুনর রশীদ বিদেশে থাকায় সংসদ ভবনে উপস্থিত না হলেও তাদের স্বাক্ষর সম্বলিত পদত্যাগপত্র স্পিকারের হাতে দেন দলীয় হুইপ রুমিন ফারহানা।
সংসদ ভবন থেকে বেরিয়ে এসে জিএম সিরাজ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা পাঁচজন আলাদাভাবে সশরীরে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। আমরা আর সংসদ সদস্য নেই। স্পিকার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। বাকি বিষয়ে উনি জানাবেন। আমাদের বাকি দুজন আসতে পারেননি। উনারা ২০ তারিখের পরে সশরীরে এসে নিয়ম অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে যাবেন।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পরে সাংবাদিকদের বলেন, তারা আমার কাছে সাতজনের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। পাঁচজন সশরীরে ছিলেন, তাদেরটা গ্রহণ করা হয়েছে। সংবিধানের ৬৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ওই আসনগুলো শূন্য হয়ে গেছে। বাকি দুজনের আবেদন যাচাই–বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেব। এর মধ্যে সংসদ সচিবালয় সাত্তার সাহেবের স্বাক্ষর মিলিয়ে দেখবেন এবং কথা বলবেন। সব ঠিক থাকলে তা গৃহীত হবে। তবে ইমেইলে দেওয়ায় হারুনের আবেদন গ্রহণ হবে না, তাকে পরে এসে জমা দিতে হবে।
আমরা এখন থেকে আর সংসদ সদস্য নই : স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে ঘণ্টাব্যাপী আলাপ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির পদত্যাগ করা সংসদ সদস্যরা। গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, আমরা ৫ জন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। বাকি দুজন পরে এসে জমা দেবেন। আমরা যে পাঁচজন পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি এই মুহূর্ত থেকে তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ হয়ে গেল। আমরা এখন থেকে আর সংসদ সদস্য নই। স্পিকার গ্রহণ করেছেন। বাদবাকি পদক্ষেপ উনি জাতিকে, গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেবেন।
দলের কৌশলগত সিদ্ধান্তে বিএনপি সংসদে এসেছিল বলে মন্তব্য করেন সদ্য সাবেক এই এমপি। স্পিকারের ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, স্পিকারের ভদ্রতা, শিক্ষা, শালীনতা–এই রকম একজন মানুষের কাছে পদত্যাগপত্র দিতে পেরেছি। আমাদের ভালোই লাগলো। আমরা চা–কফি খেলাম, আপেল, কাজু বাদাম ও সন্দেশ খেয়েছি। গল্পগুজব করলাম।
স্পিকার পদত্যাগ না করতে অনুরোধ করেছিলেন কিনা–এমন প্রশ্নের উত্তরে সিরাজ বলেন, আমরা সম্মানের সঙ্গে অনেক হাসিমুখে গল্পস্বল্প করে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। দেওয়ার সময় কবির ওই লাইনটি বলেছিলাম, আবার আসিব ফিরে।
স্পিকার ওইরকম কোনো অনুরোধ করেননি জানিয়ে রুমিন ফারহানা বলেন, সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে আলোচনা হয়েছে, ব্যক্তিগত আলাপ করেছি। সাড়ে তিন বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। সেখানে স্পিকারও তার স্মৃতিচারণ করেছেন। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে আমাদের কারও যাবার প্রয়োজন নেই। তাই স্পিকার অনুরোধ করেননি।
যা আছে পদত্যাগপত্রে : সাংবাদিকদের পদত্যাগপত্র পড়ে শোনান রুমিন ফারহানা। সেখানে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে চরম স্বৈরশাসন চলছে। বর্তমান সরকারের গণতন্ত্র ও গণবিরোধী কার্যকলাপে গণতন্ত্রহীনতা, বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর দমন–পীড়ন, গণগ্রেপ্তার, গুম, হত্যা এবং মত প্রকাশ, বাকস্বাধীনতা হরণ, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার হরণ সর্বোপরি মহান জাতীয় সংসদকে অকার্যকর করার প্রতিবাদে, জনস্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী এই সংসদের সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগ করে এই সংসদ বাতিলের গণদাবির সঙ্গে একমত পোষণ করছি এবং দলীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্বেচ্ছায়, সুস্থ শরীরে, স্থির মস্তিষ্কে অন্যের বিনা প্ররোচনায় গভীরভাবে চিন্তা ও বিবেচনার পর অদ্য ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে সংসদ থেকে যার যার আসন থেকে পদত্যাগ করলাম।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ভোটে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। সেই নির্বাচনে দলের ছয় প্রার্থী বিজয়ী হন। পরে সংরক্ষিত নারী আসনের একটি পায় বিএনপি। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে শুরুতে বিএনপি জানিয়েছিল তারা সংসদে যাবে না। পরে সিদ্ধান্ত বদলে শপথ নেন দলটির সংসদ সদস্যরা।