বাস্তবায়ন হয়নি ৭২ সুপারিশ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১১ জুন, ২০২২ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

এখানে পাহাড়ের ঢালে অথবা পাদদেশে খুবই বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। যে কোনো সময় ব্যাপক প্রাণহানিসহ মহাবিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই এক্ষুণি এই এলাকা দখলমুক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় আনা জরুরি’। নগরের লালখান বাজারের মতিঝর্ণা পাহাড়ের সম্ভাব্য ধস এবং ধসে প্রাণহানি এড়াতে এ সুপারিশটি করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। ওই বছরের ১১ জুন চট্টগ্রামের পৃথক সাতটি স্থানে পাহাড় ধসসহ ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ১২৭ জনের প্রাণহানির পর গঠিত তদন্ত কমিটি এ সুপারিশ করে। আজ শনিবার সেই ভয়াবহ পাহাড় ধসের ১৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ ওই সুপারিশটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানেও পাহাড়টিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে কয়েকশ পরিবার। ২০০৭ সালের ওই ঘটনার পর তৎকালীন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে (রাজস্ব) আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এরমধ্যে ওইদিন রেলওয়ে পাহাড়তলী এলাকার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ১২ জনের মৃত্যুর জন্য গঠিত একটি কমিটি ১৪টি এবং নগর ও আশেপাশের এলাকায় ভূমিধসে প্রাণহানির জন্য গঠিত কমিটি ৩৬টি সুপারিশ করে। একই ঘটনায় সিডিএমপির (সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি) পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক মাকসুদ কামালকে প্রধান করেও গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এ কমিটির ২২ দফা সুপারিশ ছিল। অর্থাৎ ২০০৭ সালের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনাকে ঘিরে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর ৭২ টি সুপারিশ করে। যার বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি গত ১৫ বছরে।

ফলে প্রায় প্রতিবছরই পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রাণহানি ঘটে আরো ১১৬ জনের। সবমিলিয়ে গত ১৫ বছরে নগরে ও আশেপাশে পাহাড় ধসে ২৪৩ জন প্রাণ হারায়। এদিকে সুপারিশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ করা। বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে যারা বসবাস করছেন তাদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসন করা। ২০০৭ সালের পাহাড় ধসের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) সদস্য সচিব করে গঠন করা হয় ‘পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি’। এ পর্যন্ত ২৭টি সভা করেছে ওই কমিটি। প্রতিটি সভায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে যারা বসবাস করে তাদের উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বাসায় অবৈধ ইউটিলিটি সার্ভিস অর্থাৎ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করারও সিদ্ধান্ত হয়।

কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছে গত ২৭ মার্চ। ওই সভায়ও একই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এক্ষেত্রে নগরে বিদ্যমান পাহাড়গুলোর মালিকদের অবৈধ বসতিদের তালিকা পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে হস্তান্তরের নির্দেশনা দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের চিঠিও দেয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ সাড়া দেয়নি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ বসতিদের তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া ওই সভায় গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসানকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে ওয়াসা, বিদ্যুৎ এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধিরাও সদস্য হিসেবে রয়েছেন। ওই কমিটি একটি সভাও করে। কিন্তু ওয়াসা, বিদ্যুৎ এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের প্রতিনিধিরা তাদের অবৈধ সংযোগের তালিকা প্রদান করতে পারেনি। ফলে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

এ বিষয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ নাজমুল আহসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের তালিকা করার জন্য পাহাড়ের মালিক ও বিভিন্ন সংস্থাকে আমরা চিঠি দিয়েছিলাম। একটি সংস্থা ছাড়া কেউ তালিকা দেয়নি। তাদের অসহযোগিতার কারণেই বিলম্ব হচ্ছে। তবে তাদের উপর নির্ভর করে আমরা বসে নাই। আমাদের এসিল্যান্ডদের মাধ্যমে তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছি। এসিল্যান্ডদের চিঠি দেয়া হয়েছে। তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমিন জুট মিলস পাহাড়ে প্রায় ৪০০ পরিবার রয়েছে। তাদের উচ্ছেদে অভিযান শুরু হবে। তাদের ইতোমধ্যে ৩০ দিনের নোটিশ দেয়া হয়েছে। সাতদিনের নোটিশ যাবে। এরপর উচ্ছেদ করা হবে।

অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোও সহযোগিতা করেনি। তারা অবৈধ সংযোগের তালিকা দেয়নি। তাদের প্রতিনিধির সঙ্গে বসেছি। চট্টগ্রাম ওয়াসা বলেছে তাদের সংযোগ নাই। সেখানে গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। কর্ণফুলী গ্যাস বলেছে, তাদের সংযোগ নাই। সিলিন্ডার ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, আবেদনের প্রেক্ষিতে বৈধ লাইন আছে। ওসব বৈধ সংযোগ থেকে কেউ কেউ অবৈধ সংযোগ নিয়েছেন।

এদিকে সাস্প্রতিক সময়ে তালিকা না করলেও ২০১৫ সালে করা সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, নগরে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এরমধ্যে ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার বসবাস করে। ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন ৭ পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। তবে গত কয়েক বছরে বর্ষাকালে উচ্ছেদ অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। অবশ্য ওসব অবৈধ বসবাসকারীরা আবারো ফিরে আসে পাহাড়ে। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজেট নিয়ে সমালোচনার উত্তর দিলেন অর্থমন্ত্রী, সঙ্গে প্রতিশ্রুতি
পরবর্তী নিবন্ধদুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে ই-বাইকচালক খুন