বাসযোগ্য একটি সুন্দর চট্টগ্রামই নগরবাসীর কাম্য

আয়েশা পারভীন চৌধুরী | শুক্রবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

অনেক অনেক শুভ কামনা মাননীয় মেয়র। প্রতি পাঁচ বছর পর পর একটি উৎসবমুখর পরিবেশে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে একজন নগরপিতা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষা, কয়েক মাসের নির্বাচনী যুদ্ধ ও জনগণের আস্থা অর্জনের পর জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। জন প্রতিনিধিরা হচ্ছেন জনগণের আশা ভরসার কেন্দ্র। অনেক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগ বিয়োগ করে জনগণ একজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। অনেক দিনের জমানো দাবিগুলোর এক সময়ে বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক যে অবস্থা তাতে কেউ কখনো গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, এখনো নেই। ভবিষ্যৎতে কী হতে পারে তাও কেউ জানে না। আসলেই কি একটি গণতান্ত্রিক দেশের সব ধরনের অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে নিজেকে জনসাধারণের স্বার্থে নিয়োজিত করে?-এই ধারণাটি বাস্তবতায় বার বার জনগণকে কষ্ট দেয়। এখানে ‘কষ্ট দেয়’ বলতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছি। কারণ নির্বাচিত হওয়ার পরের দিন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অন্য জগতের মানুষে পরিণত হয়ে যায়। চেনা পরিচিত সেই আপন মানুষগুলো ও পথ-ঘাটগুলো তখন তাদের কাছে অচেনা হয়ে যায়। যারা দিন-রাত পরিশ্রম করে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া সবাইকে দূরে ঠেলে দেয়। টাকা ও ক্ষমতার মানদন্ডে বিচার করে তাদেরই প্রয়োজনে নির্বাচন পরবর্তী পথ চলা শুরু করে। হয়তো সামাজিক ও জাতীয় কোন অনুষ্ঠান-আয়োজনে এই আপন মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়। কিন্তু বছরের অন্য সময়গুলোতে তাদের দেখা সাক্ষাত পাওয়া যায় না।
করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হয়েছিল। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে অনেক নেতা-কর্মী জীবন বাজি রেখে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু করোনার পুরো সময়ে সেই নেতা-কর্মীদের সেবামূলক কার্যক্রম তেমন চোখে পড়ে নি। করোনায় বিধ্বস্ত অসহায় জনগণের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় নি। দীর্ঘ সাত-আট মাস পরে আবার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আবার নেতাকর্মীদের তৎপরতা চোখে পড়েছে। এমন কি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। সকলের অক্লান্ত প্রচেষ্টা নেতাকর্মীদের জোরালো সমর্থন ও প্রাণহানির ঘটনার মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সংঘটিত হয়। দলীয় সমর্থন ও জনগণের ভালবাসায় নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনাকে শুভকামনা জানাচ্ছি।
মাননীয় নগরপিতা এখন আপনার পালা শুরু। একটা নির্বাচনের পরবর্তী ধাপ অতিক্রম করে আপনি নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনের আগে আপনি আপনার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। প্রতিদিনের নির্বাচনী প্রচারণায় জনগণের প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতদিনের কঠোর ত্যাগ ও প্রতিক্ষার পর এখন আপনি এই চট্টগ্রাম মহানগরের নির্বাচিত প্রতিনিধি। এদেশের ইতিহাসে আমাদের এই চট্টগ্রামের ভূমিকা ও অবদান অনেক অনেক উল্লেখযোগ্য ও প্রশংসনীয়। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং আজ অবধি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে চট্টগ্রাম তথা চট্টগ্রামবাসীর ভূমিকা অনন্য। তবুও চট্টগ্রামকে কেন্দ্রীয়ভাবে অবহেলিত হতে হয়। অথচ আমাদের চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন ক্ষমতাবান সাংসদ আছেন। প্রতি বার চট্টগ্রাম থেকে কয়েকজন মন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে থাকেন। এরপরও চট্টগ্রামের মূল সমস্যাগুলো সমস্যা হয়ে আছে। নাগরিক ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয় না। একজন নাগরিকের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। এই নগরবাসী আহামরি তেমন কিছু চায় না। সুন্দর, সুস্থ ও নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় জনপ্রতিনিধির দিকে চেয়ে থাকে। তবুও মৌলিক সমস্যাগুলোর তেমন সুরাহা হয় না। যে চট্টগ্রাম একটি শান্ত, সুন্দর, নিরাপদ আবাসস্থল ছিল এখন আর তেমন নেই। ঘনবসতির জন্য অনেক জায়গা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভিড় করা কর্মজীবী মানুষের আনাগোনার ফলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দিন দিন জনগণের চাপে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চট্টগ্রামের সেই সৌন্দর্য কখন যে হারিয়ে গেছে! আপনার ভূমিকাতে আপনি নিজেকে কী হিসেবে উপস্থাপন করবেন? সেটা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। একজন নগরপিতা হিসেবে নাকি নগরবাসীর একজন সেবক হিসেবে? নগরপিতা হিসেবে আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে আপনাকে আসলেই একজন সেবকের ভূমিকা পালন করতে হবে। এই নগরবাসী তেমন বেশী কিছু চায় না বলেই আপনার পথ চলাটা অনেকটা সহজ। রাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মত নয়। কারণ দিনের পর দিন প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের তেমন কোন বাস্তবায়ন না দেখে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর সাধারণ মানুষের আস্তা হারিয়ে যাচ্ছে। আপনার চারপাশে অবস্থানরত মানুষগুলো সর্বদাই আপনাকে সমর্থন করে যাচ্ছে। তারা আপনার কোন ব্যাপারে সমালোচনা করে না। একান্ত বিশ্বস্ত হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য তারা আপনার তোষামোদে ব্যস্ত থাকবেন। কিন্তু মাননীয় মেয়র, আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, সাধারণ মানুষগুলোই আপনার শক্তি। তাই এই সাধারণ মানুষগুলোর সুবিধা-অসুবিধাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে এগোতে হবে। মাননীয় সম্মানিত জনপ্রতিনিধি, এই নগরবাসী কোন আলীশান সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করে না। একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলোর সুষম বন্টনের মাধ্যমে নিরাপদ ও সুস্থ জীবন নিশ্চিত করাই এখন প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। এই চট্টগ্রামে প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে ধাপে ধাপে সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত চট্টগ্রামের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো হয়ত ফিরে আসা সম্ভব নয় কিন্তু পরিচ্ছন্ন ও সু-শৃঙ্খল চট্টগ্রামের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা কোন অসম্ভব ব্যাপার নয়। রাস্তাঘাট, অলিগলি, খোলা জায়গাগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা জানি, এই ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগ আছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটাই আসল ব্যাপার। বর্তমানে যানজট একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘন্টার পর ঘন্টা মানুষের মূল্যবান শ্রম ঘণ্টাগুলো রাস্তায় নষ্ট হয়ে যায়। এতে ব্যক্তিগত জীবনে এবং উৎপাদন কাজে সঠিক শ্রম ও মেধা ব্যয় হয় না। হঠাৎ হঠাৎ মশা মারতে কামান দাগা এর ব্যবস্থা না করে নিয়মিত এর তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। সারা বছর ধরেই মশা মারার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকলে রোগের প্রকোপও অনেকটা কমে যাবে। ডেঙ্গুর কারণে অনেকেই আপনজন হারিয়েছেন। রাস্তাঘাট যখন তখন মেরামত ও খোঁড়াখুঁড়ির ফলে যান চলাচলে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কয়েকটি কাজ কখন শুরু হয়েছে এবং আদৌ শেষ হবে কী না এই বিষয়টি মনে হয় কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভুলেই গেছেন। আগ্রাবাদ এক্সেস রোড হয়ে পিসি রোডের নির্মাণ ও মেরামত কাজটি পাঁচ-ছয় বছর হলেও আর কয় বছর লাগবে নিশ্চিত করে বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের খেলার মাঠগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। খোলা জায়গাগুলোও আবাসন সংকটের কারণে দখল হয়ে যাচ্ছে। যে কয়েকটি পুকুর ছিল তাদের বেশীর ভাগই ভরাট করে আবাসন তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে সমস্যা সমাধানের চেয়েও সংকট আরো প্রকট হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের অভাবে সামান্য বৃষ্টি হলেই চারিদিকে পানি জমে যায়। আবার কিছু কিছু এলাকায় জোয়ার-ভাটার কারণে ২৪ ঘণ্টায় পানি উঠানামা করে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, আমাদের উড়াল সড়কেও পানি জমে থাকে। বর্ষাকালে অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। নিয়মিত পাহাড় কাটার ফলে সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। ভূমিধসের ফলে প্রতি বছর মৃত্যুহার বেড়ে চলছে। এখনতো অনেক পাহাড়ের কোন চিহ্ন নেই বললেই চলে। নিম্নআয়ের মানুষের আবাসন সংকট একটি বড় সমস্যা। বিশেষ করে বস্তিগুলোতে জীবনযাত্রা মানবেতর। পয়:নিষ্কাশনের সমস্যা, পানি সরবরাহ, রান্নার অব্যবস্থা, চলাচলের অসুবিধা ইত্যাদি কারণে এই চট্টগ্রামের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত অসহনীয় সমস্যার মধ্যে যাচ্ছে। শহরের বড় বড় ড্রেনগুলোর অস্তিত্ব নেই বল্লেই চলে। আর ছোট ছোট নালা-নর্দমা সব-সময় ভরাট হয়ে থাকে বিধায় এক দিকে যেমন পানি সড়তে পারে না অন্য দিকে পরিবেশ দূষণের মত ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনার স্তূপ একটি বড় সমস্যা। নাগরিক সচেতনার অভাবে এই সমস্যাটি জনস্বাস্থ্যের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আবারো আবেদন করছি, কোন ম্যাগাসিটি নয়, বসবাসের যোগ্য একটি সুন্দর ও সুস্থ চট্টগ্রামই এই নগরবাসীর একমাত্র দাবী।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ,
ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধআপনজনের দুঃসময়ে পাশে থাকা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা