দৈনিক আজাদী– বাবার প্রিয় পত্রিকা। আজাদী অফিস– বাবার প্রিয় জায়গা। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ নভেম্বর তিনি নিজে আজাদী অফিসে গিয়ে তাঁর শুক্রবারের নিয়মিত কলাম ‘বিরস রচনা’ লেখাটি দিয়ে আসেন। যে ‘বিরস রচনা’ তাঁকে খ্যাতি–মর্যাদা দিয়েছে সেই ‘বিরস রচনা’ দিয়েই তাঁর সম্মানজনক বিদায়। একজন মানুষের এতো সুন্দর এতোটা মিলমিশ বিদায়ে আমরা বিস্মিত! বলছিলাম আমার বাবা অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের কথা। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে চট্টগ্রামের প্রাচীন দৈনিক আজাদীতে বাবা ‘বিরস রচনা’ ‘ইবনে সাজ্জাদ’ ছদ্মনামে লিখে আসছিলেন। এটি ছিলো পাঠকপ্রিয় কলাম। বাবা একসময় পত্রিকা পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন আমাদের মাঝে। বিশেষ করে আজাদী পত্রিকার মধ্যদিয়ে। তারপর থেকে বাবার কলাম পড়া শুরু। সেই থেকে পত্রিকা পড়ার প্রতি ভালো লাগা। সেই ভালো লাগার আজাদী এখনো ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে। যে পত্রিকার এই কলামটি সবার কাছে যেভাবে প্রিয় হয়ে ওঠে, তেমনি আমার কাছেও প্রবল ইচ্ছেজাগা কলাম হয়ে দাঁড়ায় ‘বিরস রচনা’। প্রতিদিন সকাল হতেই হাতে নিতাম আজাদী। শুক্রবার সকালবেলা তো অন্যরকম ভালো লাগার দিন। কারণ হকার আসবে, আজাদী দিয়ে যাবে আর আমি আজাদী পড়বো। আমার কাছে আশ্চর্য লাগে, বাবা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে মৃত্যুদিন পর্যন্ত এই একটি পত্রিকায় সাধুভাষায় বিরস রচনাটি লিখে গেছেন। আমাদের জানা নেই, বাংলাদেশে টানা ২২ বছর ধরে বিরতিহীনে কলাম লিখে যাওয়া কলামিস্টের কথা। আজকের এই দিনে বাবাকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা।
২.
আমরা যখন স্কুলপড়ুয়া তখন থেকেই বাবাকে দেখতাম– বাবা বের হতেন খদ্দরের ব্যাগ নিয়ে, আর ফিরে আসতেন ব্যাগভর্তি বই নিয়ে। বিশেষ করে ছোটদের বুক অব নলেজ, ছোটদের বিশ্বকোষ, মজার অ্যাক্সপেরিমেন্ট, অংক নিয়ে খেলা ইত্যাদি। অর্থাৎ বাবার জীবনটাই ছিলো বইময়।
তাঁর শেষদিনটিও কেটেছে বই এবং লেখালিখি নিয়ে। বাবা বলতেন, বই–ই আমার সম্পদ। আমার জীবদ্দশায় আমি এ সম্পদ হারাতে চাই না এবং যক্ষেরধনের মতো বইগুলো শেষদিন পর্যন্ত তিনি আগলেও রেখেছিলেন। প্রিয় বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় বইগুলো প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান চাচার অনুরোধে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাকলিয়া শহীদ নূর হোসেন–ডা. মিলন–মোজাম্মেল–জেহাদ ডিগ্রি কলেজের লাইব্রেরিতে দান করি। এই কলেজে বাবার নামে তাঁরা একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তোলে। নাম দেয় ‘অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান স্মৃতি পাঠাগার’। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার বাবার ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত বলে জেনেছি।
৩.
আমার বাবা তাঁর মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। সেই ভালোবাসা আমার দাদির মৃত্যুর পরও দেখতে পাই আমরা। দাদির মৃত্যুস্মরণে আমার বাবা তাঁর বিরস রচনায় একটি লেখাও লিখেন। সেখানেই ফুটে উঠে মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যবোধ, শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা। একজন মা তার সন্তানকে কিভাবে কষ্ট সয়ে লালন–পালন করেন তার অসাধারণ চিত্রও আঁকেন এই বিরস রচনায়। আজও মনে পড়ে, এই লেখাটি পড়ে অনেকেই বাবাকে টেলিফোন করেছিলেন। তাদের ভালো লাগার কথা জানিয়েছিলেন।
৪.
আমার বাবার বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা এবং তাঁর মনন–চিন্তাচেতনা আমাদের অবাক করতো। আর এখন অনেক বেশি ভাবায়। মনে পড়ছে সেসব কথা। খুব গভীর অথচ সহজ চিন্তাভাবনা করতে পারতেন তিনি। তাঁর প্রতিটি লেখায় সেই চিন্তার ছাপ রয়েছে। একটি কথা আমার এখনও মনে পড়ে। বাবাকে নিয়ে একবার আমি নগরীর অভিজাত এলাকা খুলশীর এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাই। ফেরার পথে বাবাকে এ এলাকার অভিজাত এবং দৃষ্টিকাড়া বাড়িগুলো দেখানোর চেষ্টা করি। এতো এতো টাকা খরচ করতে পারে মানুষ বাড়ির জন্য? বাবা আমার এমন প্রশ্নে বলেন, দেখো পৃথিবীতে এমন কোনো নজির নেই যে, দৃষ্টিনন্দন এবং অভিজাত বাড়ি করে কেউ ইতিহাস হয়ে রয়েছেন! বাড়ির পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে কারো স্মরণযোগ্য ইতিহাস রচিত হবে না, হয়নি এবং এই নিয়ে বেঁচেও থাকেনি কেউ। মানুষ বাঁচে কর্মের মাঝে, অর্থের মাঝে নয়; প্রাচুর্যের মাঝে না। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে কর্মের মধ্য দিয়েই বাঁচতে হবে। অন্যপথে অসম্ভব।
৫.
বাবা বলেছিলেন, তোমার মা মারা গেলে আমার পাশেই তাকে দাফন করবে। মৃত্যুর ক’দিন আগেও এই উচ্চারণ শুনতে হয়েছে আমাদের। আমার বাবার মৃত্যুর ৪ বছর পর আমার মাও ইন্তেকাল করেন। বাবার কথা মতো আমার মাকে তাঁর পাশেই সমাহিত করি। আমার মা ইন্তেকাল করেন ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর। ইতোমধ্যে আমার চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গনি খানও চলতি বছরের ৭ এপ্রিল, শুক্রবার ৭৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকেও আমার বাবার পাশে সমাহিত করা হয়। আল্লাহ যেন তাঁদেরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন, আমিন।
দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের স্মরণে এবং বিশেষ দিবসে তিনি কলাম লিখেছেন। বিভিন্নজনের মৃত্যুতে বাবার কলাম লেখাকে কেন্দ্র করে আমার বড়মেয়ে জাহিন তার দাদাভাইকে (তাঁর মৃত্যুর ক’দিন পূর্বে) বলে, তুমি তো অনেকের মৃত্যুতে লিখছো। তোমার মৃত্যুর পর কেউ কি তোমাকে নিয়ে লিখবে? নাতনির এমন প্রশ্নে নিশ্চুপ থেকেছিলেন দাদা। আমার মেয়ে জাহিনের এই সংশয়কে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে নবীন–প্রবীণ অসংখ্য লেখক আমার বাবাকে নিয়ে কলম ধরেছেন। এ বছর বাবার মৃত্যুর দশ বছর হয়ে গেলো। এই দশ বছরে চট্টগ্রামের আজাদী থেকে শুরু করে পূর্বকোণ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রায় অর্ধ–শতক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যেসব বরেণ্য ও তরুণ লেখকরা তাঁকে নিয়ে লিখেছেন, মূল্যায়ন করেছেন তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি আমাদের পরিবারের তরফ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। সবচে বড় প্রাপ্তি আমার বাবাকে নিয়ে চট্টগ্রামের খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা গলুই প্রকাশনের কর্ণধার প্রাবন্ধিক কাজী সাইফুল হক সম্পাদিত ‘অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান : জীবন ও শিল্প’ নামক ৪০০ পৃষ্ঠার ঢাউস সাইজের স্মারকগ্রন্থ। এ গ্রন্থে ১০৬ জন লেখকের লেখা রয়েছে এবং আমার বাবার জনপ্রিয় কিছু লেখাও সেখানে স্থান পেয়েছে। এমন পরিচ্ছন্ন কাজের জন্য সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই।
এই বইটি যখন আমি আমার বাবার সুহৃদদের হাতে পৌঁছাই তখন অনেকেই আমাকে বলেন, তোমাদের পরিবার তোমাদের বাবাকে মনে রাখার মতো কাজ করেছে। এখন তো মানুষ মরে গেলে মানুষকে ভুলে যায়। মাটির নিচেই চাপা থাকে তার ভালো কর্ম ভালো চিন্তাগুলো। তোমরা তোমাদের বাবাকে অমর করেছো এই একটি স্মারকগ্রন্থ দিয়ে।
আজ বাবার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। সময় কত সংক্ষিপ্ত! মহাকালের হিসাবে দশ বছর যেন এই তো কিছুটা সময় মাত্র! হ্যাঁ, তেমনটাই। দশ বছর পূর্বেও যে বিরস রচনার জন্য শুক্রবারের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম, প্রতি সপ্তাহান্তে সেই শুক্রবার ফিরে আসলেও আসে না ‘বিরস রচনা’। চিরদিনের মতো বঞ্চিত হলাম বাবার প্রিয় লেখা থেকে। এই অসীম বেদনা নিয়ে প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাজ শেষে চকবাজার কাপাসগোলা জামে মসজিদ কবরস্থানে দাঁড়িয়ে পাঠ করি– ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা’। “হে আল্লাহ, আপনি আমার পিতা–মাতার প্রতি রহম করুন; যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন–পালন করেছেন।”
লেখক : অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের জ্যেষ্ঠপুত্র ও ব্যাংক কর্মকর্তা।