চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৭ আসামিকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পরেশ বড়ুয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ওই মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রায় দেন। খবর বাসস ও বিডিনিউজের।
আদালত সূত্র জানায়, খালাস পাওয়া অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ কে এম এনামুল হক, জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমীন, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম। খালাস পাওয়া আসামিদের মধ্যে জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম মারা যাওয়ায় তাদের ক্ষেত্রে মামলা অকার্যকর হয়ে গেছে। আর হাইকোর্টে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্তরা হলেন আকবব হোসেন, লিয়াকত, সাহাবুদ্দিন, হাফিজ, মঈনুদ্দিন, হাজি আব্দুস সোবহান।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী এটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান। পাঁচজন আসামির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান। বাবরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
রায়ের পর শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে সর্বমোট খালাস পেয়েছেন সাতজন। সাতজনের মধ্যে চারজন খালাস পেয়েছেন যারা কন্টেস্ট করেছেন। একজন খালাস পেয়েছেন যিনি পলাতক ছিলেন.. নুরুল আমিন। এছাড়া দুটি আপিল এবেটেড হযে গেছে; মতিউর রহমান নিজামী এবং আব্দুর রহিম। উনাদের আগেই মৃত্যু হয়েছে। এরপরে বাকি ছয়জনকে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। আরেকজন পরেশ বড়ুয়া, যাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে।
শিশির মনির বলেন, এই মামলার মূল বিষয়বস্তু দাঁড়িয়েছিল আদালত দেখবে সঠিক ইনভেস্টিগেশন হয়েছে কিনা, প্রপার ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রপার চার্জ এবং প্রপার সাক্ষ্য–প্রমাণ হাজির করা হয়েছে কিনা। লুৎফুজ্জামান বাবরকে এ মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছিল দ্বিতীয় তদন্তের ভিত্তিতে। এই জন্য লুৎফুজ্জামান বাবরকে আজকে খালাস দিয়েছেন এই কথা বলে যে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ভিক্টিম এবং তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য–প্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেনি। তার বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ আনা হয়েছিল যে তিনি পাঁচজনকে প্রভাবিত করে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই পাঁচজনই আদালতে হাজির ছিল, পাঁচজনই ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি করেছে। সুতরাং পাঁচজনকে মুক্তি দেওয়া হয় নাই। আর দ্বিতীয় তদন্ত করে দ্বিতীয় অভিযোগ আনা হয়েছিল যে তৎকালীন (বিএনপি) সরকারের আমলে একটি তদন্ত রিপোর্ট হয়েছিল, ওই তদন্ত রিপোর্ট নাকি লুৎফুজ্জামান বাবর সাহেব প্রভাবিত কছিলেন। এ আইনজীবী বলেন, এই তদন্ত রিপোর্টের প্রধান ছিলেন তখনকার যিনি স্বরাষ্ট্র সচিব, তিনি আদালতে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। যিনি তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন তিনিও সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ দিতে পারেননি। ফলে লুৎফুজ্জামান বাবরকে এ মামলা থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে আমরা ছিলাম। উনি আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। উনার যে ফাইনটা, সেটা থেকেও অন মেরিট খালাস করে দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে বন্দরনগরীর কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে চোরাচালান মামলায় (বিশেষ ক্ষমতা আইনে) সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ আসামিকে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল–১ এর বিচারক এসএম মজিবুর রহমানের আদালত। অস্ত্র আইনে আনা অন্য মামলাটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন একই আসামিরা। এছাড়া অস্ত্র আটক মামলার অপর ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড দেন বিচারক। দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য ১১ জন হলেন এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআই’র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, ডিজিএফআই’র সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, এনএসআই’র সাবেক উপ–পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, এনএসআই’র সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএল’র সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমিন, চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান, অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ ও ট্রলার মালিক হাজী আবদুস সোবহান।