বাপেক্সকে আরো বেশি কার্যকর করে সক্ষমতা বাড়ানো দরকার

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ২১ জুন, ২০২১ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান ও উৎপাদনে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানী লিমিটেড (বাপেক্স)। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮৯ সালের ১লা জুলাই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১২টি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। যদিও ২০০২ সালের ২৩শে এপ্রিল এটিকে তৈল গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানী হিসেবে গঠন করা হয়। বর্তমানে এর জনবল ৬৮৯। বাপেক্স এখন পর্যন্ত উন্নয়ন করেছে ১৭টি কূপ (বাপেক্স মালিকানাধীন ১১টি সহ) ও মোট ওয়ার্কওভার কূপ ৩৪ টি (বাপেক্স মালিকানাধীন ৭টি সহ)। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ৯টি যার মধ্যে উৎপাদনক্ষম ৭টি, মজুদ ২৫৫৯.৩৫ বিসিএফ গ্যাস ও দৈনিক উৎপাদিত গ্যাস ১০৫.৫ মিলিয়ন ঘনফুট।প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ভূতাত্ত্বিক জরীপ করেছে ৩,০৯৬ লাইন কিলোমিটার। দ্বিমাত্রিক ভূ-কম্পন জরীপ করেছে ১২,৭২৩ লাইন কিলোমিটার এবং ত্রিমাত্রিক ভূ-কম্পন জরীপ করেছে ৪০৭০ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে খনন রিগের সংখ্যা ৪টি। ওয়ার্কওভার রিগের সংখ্যা ২টি, মাড ল্যাবরেটরি ৪টি, মাডলগিং ইউনিট ৩টি, সিমেন্টিং ইউনিট ২টি। এটি দেশের একমাত্র তৈল গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান হলেও গত ৩২ বছরে প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে শক্ত ভিতের উপর দাড় করাতে পারেনি। ফলে এই খাতে বিদেশী কোম্পানির নির্ভরতা বেড়েছে এবং দুর্বল হয়েছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা। বাপেক্সের বিষয়ে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া ও পরিচালনা পর্ষদে বিশেষজ্ঞ না থাকার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়াতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাপেক্সে গত আট বছরে আটজন এমডি পরিবর্তন হয়েছেন। তাছাড়া এর বোর্ড সভায় সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য হওয়ায় এটি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে পারছে না। অথচ জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাপেক্স দেড় হাজারের বেশি ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে খুব অল্প খরচে এবং এই জরিপের ভিত্তিতে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনাসহ দক্ষিণ অঞ্চলের নতুন ধরনের ভূকাঠামোতে বিপুল গ্যাস থাকার আভাস মিলেছে। কিন্তু সেখানে যত সংখ্যক কূপ খনন করা দরকার, তার অনুমতি সরকার দেয়নি।
এসব বিষয় উঠে এসেছে গত ৩ অক্টোবর ২০২০ অনুষ্ঠিত ‘এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট চ্যালেঞ্জ ফর বাপেক্স’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বাপেক্সকে কিভাবে শক্তিশালী করা যায়,এমন প্রশ্নের জবাবে জালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাপেক্সের ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। এটিকে জালানি মন্ত্রণালয় হতে মুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশী বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে এটি পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাপেক্সকে চারটি রিগ কেনার পাশাপাশি একটি পরিকল্পনা দেওয়া হয়। সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে ৫৫টি অনুসন্ধান কূপ, ৩১টি উত্তোলন কূপ ও ২২টি পুরানো কূপ সংস্কার করার কথা বলা হয়। এগুলো করা গেলে দৈনিক ৯০ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বাড়বে।এ প্রকল্পে অর্থের জন্য গঠন করা হয় ‘গ্যাস উন্নয়ন তহবিল’ যাতে প্রতি বছর জমা হয় ১৮০০ কোটি টাকা। তবে গত ১০ বছরে বাপেক্স মাত্র ১২টি কূপ খনন ও চারটি কুপ সংস্কার করেছে। এরিমধ্যে দুই আড়াই গুণ বেশি দামে বিদেশী কোম্পানি দিয়ে সাতটি কূপ খনন করানো হয়েছে। ফলে প্রায় পুরোসময় বাপেক্স বসে ছিলো দামী ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও লোকবল নিয়ে।
বাপেক্সের একটি সূত্র জানায় প্রতিটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের খরচ হয় ৮০ কোটি টাকা। আর বিদেশি কোম্পানি নেয় ১৫০ কোটি টাকা। ত্রিমাত্রিক জরিপে বাপেক্সের খরচ হয় ৯-১৩ লাখ টাকা/কিলোমিটার। আর বিদেশী কোম্পানি গুলো নেয় প্রায় দুই কোটি টাকা।এরপরেও বাপেক্স নিস্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে। অবশ্য জালানি মন্ত্রী বলেন, বাপেক্স নিজেরাই চায় না তারা শক্তিশালী হউক। তিনি বলেন, এই সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর চারটি নতুন রিগ কিনে দিয়েছে। ১৫০০ হাজারের বেশি ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে, বেশ কিছু নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। কিন্তু তারপরও বলবো কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রায় যেতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, তাদের বলা হয়েছিলো পুরানো গ্যাস ক্ষেত্রের একটি মূল্যায়ন করার। ছয় মাসেও তারা সেটি শুরু করেনি। তারা চায় সরকারি অফিসের মত ধীর গতিতে চলতে। বাপেক্সের কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমি এ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার পর বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের দেখলাম, তারা যখন বাপেক্সে থাকেন তখন কোনো শব্দ করেন না। বাপেক্স থেকে বের হলেই তারা বাঘের বাচ্চা হয়ে যান। যখন তাদের নিজেদের ক্ষেত্রে কাজ দেওয়া হয়, তখন তাদের মাথা থেকে কোনো পরিকল্পনা আসে না। তিনি বলেন, আমি দেখলাম একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের নিজেদের লোকরাই নিজেদের দোষারোপ করেন। যারা বাপেক্সে চাকরি করেন তারাও দোষারোপ করেন, আবার যারা চাকরি শেষ করে বের হয়েছেন তারাও দোষারোপ করেন। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বাপেক্স চার হাজার বর্গ কিলোমিটার এর বেশি এলাকায় দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার ছিল ত্রিমাত্রিক জরিপ।এতে প্রতি কিলোমিটারে গড়ে ব্যয় হয় ৮ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। বাপেক্সের সাবেক এমডি মর্তুজা আহমেদ তিনটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাপেক্স দিয়ে সিলেটে ত্রিমাত্রিক জরিপ করতে প্রতি কিলোমিটার ব্যয় হয়েছে ৮০ লাখ টাকা।এ ছাড়া দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ২ কোটি ৭০ লাখ ও দিঘীপাড়ায় ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়।
উপস্থাপনায় আরও বলা হয়, ১৯৮৯ সালে বাপেক্স প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সংস্থাটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও কূপ খননে বাপেক্সের সাফল্যের অনুপাত ২:১। আন্তর্জাতিকভাবে পাঁচটি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পেলে সেটিকে সাফল্য বলে মনে করা হয়।দেশে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন এখন পর্যন্ত প্রতি চারটি কূপ খনন করে একটিতে গ্যাস পেয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, দেশের তিন পার্বত্য জেলায় এখনো গ্যাসের অনুসন্ধান হয়নি। সেখানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারণ সীমান্তের ওপারে একই ধরনের ভূকাঠামোয় ভারত একের পর এক কূপ খনন করে গ্যাস পাচ্ছে। তিনি বলেন, বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে হলে তাদের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো তাদেরকে দিয়েই খনন করাতে হবে। তাঁর মতে মূলত বিদেশী কোম্পানি ও এলএনজি ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার এটিকে শক্তিশালী করছে না।
২০১২ সালের সমুদ্র বিজয়ের পর বাংলাদেশের মোট গ্যাস ক্ষেত্র হলো ৪৮ টি।এর মধ্যে ভূমিতে ২২ টি ও সমুদ্র বক্ষে ২৬ টি।যার মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ২৭ গ্যাস ক্ষেত্র খনন করে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।বাকী ২১টি ক্ষেত্রে অনুসন্ধান শুরু করা এখনো বাকী। অথচ দেশে এখন যে গ্যাস মজুদ আছে (৭.২৫ টিসিএফ) তা আগামী ৭-৮ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বাকী ব্লক গুলোতে গ্যাস অনুসন্ধান করা দরকার। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তে অবস্থিত ক্ষেত্রগুলোতে অনুসন্ধান করে পার্শ্ববর্তী দেশের আগে গ্যাস উত্তোলন করতে না পারলে, ঐ সকল ক্ষেত্র হতে গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে না। কারণ পাশ্ববর্তী দেশগুলো আমাদের আগে ঐ গ্যাস উত্তোলন করে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সীমান্তবর্তী এলাকায় দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে দিয়ে অতি দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সেই জন্য বাপেক্সকে আরো বেশী কার্যকর করে তাদের সক্ষমতা বাড়ানো উচিত এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাপেক্সকে দিয়ে আরো বেশী কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। এই বিষয়ে অতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই আশা আমরা করতেই পারি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহে আল্লাহ! সবাইকে সুস্থ রাখুন, ভালো রাখুন
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা-শিক্ষা : আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে