বাণিজ্য সম্পর্ক : বাংলাদেশ-ভারতের অবিস্মরণীয় কাজের সূচনা

| শুক্রবার , ১৪ জুলাই, ২০২৩ at ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ও ভারত অবিস্মরণীয় একটি কাজের সূচনা করলো। ডলার সংকটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে লেনদেন নিষ্পত্তির বিকল্প তৈরির চেষ্টায় আনুষ্ঠানিকভাবে রুপিতে লেনদেনের যুগে প্রবেশ করলো এই দুটি দেশ। গত মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে দীর্ঘ আলোচনা শেষে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি শুরুর বিষয়টিকে একটি ‘বড় সূচনার প্রথম পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ঝুড়িতে থাকা ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনবে রুপির লেনদেন। বড় কোনো যাত্রার প্রথম পদক্ষেপ এটি। সামনের দিকে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কে আরো বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে আজকের এই উদ্যোগ। ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, রুপিতে আমদানিরপ্তানি শুরু হওয়ায় দুই দেশের বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন হলো। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বাণিজ্যিক অংশীদার। রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করল। রুপিতে লেনদেন শুরু আমাদের অংশীদারত্বের ভিত্তিতে উন্নয়ন ও অভিন্ন সংস্কৃতির ঘোষণার বিষয়টিই প্রমাণ করে।

অনুষ্ঠানে রুপিতে ভারত থেকে আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। বগুড়ার কোম্পানি তামিম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কাছ থেকে ১ কোটি ৬০ লাখ ভারতীয় রুপির পণ্য কেনার জন্য ভারতীয় আমদানিকারকের এলসি খোলার মধ্য দিয়ে হয় প্রথম লেনদেন। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) ঢাকা শাখার মাধ্যমে এ রপ্তানি করা হয়। ভারতের আমদানিকারক ঋণপত্র (এলসি) খোলে দেশটির আইসিআইসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে রুপিতে প্রথম আমদানি করে নিটা কোম্পানি। এসবিআই ঢাকা শাখার মাধ্যমে তারা এক কোটি ২০ লাখ রুপির পণ্য আমদানির আদেশ দেয়। এসবিআইয়ের মুম্বাই শাখা পণ্য আমদানিতে ভারতে প্রতিনিধি ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। প্রথম আমদানিরপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি হিসেবে কোম্পানিগুলোর মালিকদের অনুষ্ঠানে দেওয়া হয় স্মারক উপহার।

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রুপিতে লেনদেন চালু হওয়ার পর পাঁচ মাসের মধ্যে টাকা ও রুপিতে লেনদেনযোগ্য ডেবিট কার্ড চালুর ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বাংলাদেশের নিজস্ব এ ডেবিট কার্ডের নাম হবে ‘টাকা পে কার্ড’। এ কার্ড ব্যবহার করে ডুয়েল কারেন্সি সুবিধায় ভারতীয় রুপি ও টাকায় লেনদেন করতে পারবেন একজন গ্রাহক।

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কেননা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য কমেছে বাংলাদেশের। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২২৩ ভারতীয় অর্থবছরে (এপ্রিল ২০২২মার্চ ২০২৩) দুই দেশের বাণিজ্যের আকার হ্রাস পেয়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৩১ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ভারত। রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে। তবে দুই দেশের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রায় (টাকা ও রুপি) বাণিজ্য শুরুর পর এ পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন তাঁরা।

পত্রিকান্তরে ভারতীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটা পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০২১ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে পণ্য বাণিজ্য হয়েছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ওই সময়ে দুই দেশের মধ্যে মোট পণ্য আমদানিরফতানি হয়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৩২ লাখ ডলারের। পরের অর্থবছরে (এপ্রিল ২০২১মার্চ ২০২২) তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮১৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলারে। গত মার্চে সমাপ্ত ২০২২২৩ ভারতীয় অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের অর্থমূল্য ছিল ১ হাজার ২৫০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এ হিসেবে এক অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আকার কমেছে ৫৬৩ কোটি ডলারের কিছু বেশি বা ৩১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। বাণিজ্য খাতের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় যোগাযোগ ও পণ্যের প্রাপ্যতাএ দুই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যে কিছু মাত্রায় ভারতনির্ভরতা রয়েছে বাংলাদেশের। গত অর্থবছরে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য, বিশেষ করে আমদানি কমায় ডলারের ওপর চাপ কিছু কমেছে। ভারতের বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২২২৩ ভারতীয় অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে পণ্য রফতানিও হ্রাস পেয়েছে। আগের অর্থবছরের চেয়ে ২০২১২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮১ শতাংশ। ২০২২২৩ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৬ শতাংশে। তবে দেশটিতে এ সময় বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে। নিট ও ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে এ প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৩৮ ও ৩০ শতাংশ।

বর্তমানে ডলারের সংকটের কারণে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারতের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারছেন না। তাই সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত দুয়েক বছরটা শ্লথগতি দেখা গিয়েছে। কারণ আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে আমদানি কমে গেলে বাকি সব ব্যবসাও কমে যায়। স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্য কমেছে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ভারতীয় পরিসংখ্যানে। এমতাবস্থায় রুপিতে লেনদেনের সূচনা হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা আশা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেন, ভারতে এখন আমাদের পণ্যের বাজার প্রবেশাধিকার আছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বাণিজ্য বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকবে। আবার বাংলাদেশেও ভারতীয় পণ্যের প্রবেশাধিকার বাড়বে। বাণিজ্য সহজীকরণ হবে। ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা উভয় দেশের উদ্যোক্তাদের বাণিজ্য খরচ কমে আসার পাশাপাশি ডলার নির্ভরতাও কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে