পাইপসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় সংকটসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে হুমকির মুখে পড়েছে নগরীতে গ্যাসের এক লাখ প্রি–পেইড মিটার স্থাপন প্রকল্প। গত জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শুরুতে গতিশীল থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে এসে থমকে গেছে। গ্রাহকদের প্রচণ্ড আগ্রহ থাকলেও রাইজার থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত প্রতিটি চুলার জন্য আলাদা আলাদা আধা ইঞ্চি জিআই পাইপের লাইন তৈরি এবং লাইনে কোনো লিক বা ত্রুটি থাকলে সারিয়ে নেয়ার বাড়তি খরচের বাধ্যবাধকতায় অনেকে ইচ্ছে থাকলেও প্রি–পেইড মিটার লাগাতে পারছেন না। শুরুতে প্রতিদিন যেখানে ৪শর বেশি মিটার স্থাপন করা হতো সেখানে বর্তমানে তা দুইশতে নেমে এসেছে। আগামী বছরের জুনে ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) গৃহীত প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস চুরি, অবৈধ সংযোগ বন্ধ এবং সর্বোপরি অপচয় ঠেকাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের আবাসিক গ্রাহকদের প্রি পেইড মিটারের আওতায় আনতে পদক্ষেপ নেয় সরকার। প্রথম দফায় ২০১৮ সালে নগরীতে ৬০ হাজার প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। মাত্র বছর দেড়েক সময়ের মধ্যে নগরীর জামালখান, হালিশহর, চান্দগাঁও, কোতোয়ালী, খুলশী, নাসিরাবাদ, লালখান বাজার, আন্দরকিল্লা, চকবাজার, কাজীর দেউড়ি, পাঁচলাইশসহ বিভিন্ন এলাকার ৬০ হাজার আবাসিক গ্রাহককে প্রি–পেইড মিটারের আওতায় নিয়ে আসা হয়। জাপান সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহায়তায় এসব মিটার স্থাপন করা হয়। কর্ণফুলী গ্যাসের প্রায় ৬ লাখ আবাসিক গ্রাহকের মাঝে প্রথম দফায় ৬০ হাজার গ্রাহককে প্রি–পেইড মিটার দেয়া হলে বেশ সাড়া পড়ে।
জাপান থেকে আনা উন্নতমানের প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের পর নগরীর আবাসিক খাতে গ্যাসের খরচ বহুলাংশে কমে যায়। কমে যায় গ্যাসের অপচয়। এক চুলা কিংবা দুই চুলা হিসেবে নির্দিষ্ট হারে যে বিল গ্রাহকদের পরিশোধ করতে হতো; তার থেকে অনেক কমে পুরো মাসের রান্নার কাজ সেরে যাওয়ায় প্রি–পেইড সিস্টেম জনপ্রিয় হয়ে উঠে। প্রি–পেইড মিটার চালুর ফলে চট্টগ্রামে গ্যাস খাতে কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে বলে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, চুলা না জ্বালালে কোনা বিল আসছে না। বাসা খালি থাকলেও সিঙ্গেল বার্ণারে ৯৯০ টাকা এবং ডাবল বার্ণারে ১০৮০ টাকা বিল পরিশোধের যে নিয়ম চালু আছে, প্রি–পেইড মিটারের ক্ষেত্রে তাও থাকে না। গ্যাস ব্যবহার না করলে কোনো খরচ হয় না, শুধুমাত্র কার্ড রিফিল করার সময় মিটার ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ২০০ টাকা আদায় করা হয়। আবার নিজেরাও ইচ্ছে করলে বিল সাশ্রয় করতে পারছে। পোস্টপেইড চুলা থেকে প্রি–পেইড মিটারে খরচ অনেক কমে যাওয়ায় গ্রাহকেরা এই সিস্টেমের আওতায় আসতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
গ্রাহকদের আগ্রহের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে নতুন করে আরো ১ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের জন্য পৃথক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২৪১ কোটিরও বেশি টাকার এই প্রকল্পটির নানা প্রক্রিয়া শেষ করে গত জানুয়ারি মাস থেকে প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। জাপানের টয়োকিকি কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১ লাখ প্রি–পেইড মিটার স্থাপন করবে। গ্রাহকদের বাসাবাড়ির লাইনগুলো প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের উপযোগী হলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রাইজারের পাশেই প্রি–পেইড মিটার স্থাপন করে দেয়া হবে। এজন্য কোনো ফি বা টাকা নেয়া হবে না। তবে লাইন ঠিক না থাকলে প্রি–পেইড মিটার স্থাপন করা সম্ভব হবে না। রাইজার থেকে রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত পাইপ লাইনে কোনো লিক থাকলে কিংবা একই লাইনে একাধিক চুলা থাকলে সেখানে প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের সুযোগ নেই। অনেক বাড়িতে রাইজার থেকে একটি লাইন নিয়ে তা থেকে পুরো বিল্ডিংয়ের সবগুলো চুলাতে সাব লাইন দেয়া হয়ে থাকে। প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের আগে এই ধরনের লাইনগুলো সিঙ্গেল লাইন অর্থাৎ রাইজার থেকে আধা ইঞ্চি জিআই পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি চুলার জন্য আলাদা আলাদা লাইন টানতে হবে। এছাড়া প্রি–পেইড মিটার সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। রাইজার থেকে প্রতিটি চুলার আলাদা লাইন গ্রাহককে নিজ খরচে করতে হবে।
বর্তমানে এই লাইন আলাদা করার বাড়তি খরচ বহন করতে রাজি নন অনেক গ্রাহক। জানা গেছে, পাইপসহ আনুষাঙ্গিক জিনিজপত্র এবং মিস্ত্রির মজুরি খরচ বৃদ্ধি–ই গ্রাহকদের এই অনীহার প্রধান কারণ।
তাই আগ্রহ থাকলেও বহু গ্রাহক প্রি–পেইড মিটার লাগাচ্ছেন না। গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভবনের উচ্চতা ভেদে একেকটি চুলার জন্য আলাদা লাইন করতে ১৫/২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি খরচ হচ্ছে। একটি বহুতল ভবনে কোনো গ্রাহককে যদি দশটি চুলার লাইন আলাদা করতে হয় তাহলে তাকে লাখ দুয়েক টাকার কাছাকাছি বাড়তি খরচের ধকল সামলাতে হচ্ছে। এছাড়া ভাড়া বাসায় গ্যাসের বিল ভাড়াটিয়া পরিশোধ করে থাকে। তাই বাড়ি বা ভবনের মালিক প্রি পেইড মিটারের জন্য বাড়তি অর্থ খরচের চাপ নিতে চাচ্ছেন না।
এক লাখ প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হওয়ার পর অনেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে মিটার লাগিয়েছিলেন। অনেকেই মিটার লাগানোর কার্যক্রম শুরুর বেশ আগে থেকে অনলাইনে আবেদন করে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু দিন গড়ানোর সাথে সাথে বাড়তি খরচের চাপে দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। প্রথম দিকে দৈনিক ৪শ’রও বেশি মিটার লাগানো হলেও গত কিছুদিন ধরে তা দৈনিক ২শ’র নিচে নেমে এসেছে। কাজ শুরুর ১০ মাসের মাথায় এসে নগরীতে অন্তত ৭০ হাজার প্রি পেইড মিটার স্থাপনের কথা থাকলেও সেখানে মাত্র ৪২ হাজার চুলায় মিটার লাগানো সম্ভব হয়েছে। আরো ৫৮ হাজার প্রি–পেইড মিটার আগামী জুনের মধ্যে লাগাতে হবে। কিন্তু গ্রাহকদের অনাগ্রহে নির্দিষ্ট সময়ে বাকি মিটারগুলো লাগানো সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, প্রি–পেইড মিটারে খরচ কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের আগ্রহ রয়েছে, কিন্তু বাড়তি খরচই তাদের ভাবনায় ফেলছে। আলাদা লাইন করার যে খরচ এককালীন করতে হচ্ছে সেটাই পুরো প্রকল্পটিকে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বলেও ওই প্রকৌশলী মন্তব্য করেছেন।