বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক কাছিমের সংখ্যা দিন দিন কমছে আর বেড়ে যাচ্ছে জেলিফিশের সংখ্যা। এরফলে সাগরের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় পরিবেশে সামুদ্রিক কাছিমের গুরুত্ব তুলে ধরতে আজ ১৬ জুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব সামুদ্রিক কাছিম দিবস’। একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত সামুদ্রিক কচ্ছপ। এটি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসাবেও বিবেচিত। পরিবেশে এই ধরনের প্রজাতির বেঁচে থাকার উপর নির্ভর করে আরো বহু প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব। কাছিমকে ‘সামুদ্রিক ঝাড়ুদার’ও বলা হয়। এরা সমুদ্রের পঁচা–গলা বস্তু খেয়ে দূষণ পরিষ্কার করে।
বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, সামুদ্রিক কচ্ছপ পানির বাইরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা স্থলে ও সমুদ্রে একটি খাদ্য জালের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে কাজ করে। এরা সৈকতের বালিয়াড়িতে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার মাধ্যমে সৈকতকেও পরিবেশগতভাবে সাহায্য করে। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিমের খোসা মাটিতে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে, যা টিলা বা বালিয়াড়ির গাছপালা ও অন্যান্য উদ্ভিদকে পুষ্ট করে। আর এর মাধ্যমে বালিয়াড়িকে স্থিতিশীল করে, উপকূলীয় ক্ষয় রোধ করতে সহায়তা করে এবং সাগরতীরের জৈব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বিজ্ঞানীরা জানান, বিশ্বে সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ রয়েছে। এরমধ্যে ফ্ল্যাটব্যাক (নাটাটোর ডিপ্রেসাস), সবুজ কাছিম (চেলোনিয়া মাইডাস), হঙবিল (ইরথমোচেলিস ইব্রিকাটা), লেদারব্যাক (ডার্মোচেলিস করিয়াসিয়া), লগারহেড (ক্যারেটা কেরেটা), অলিভ রিডলি (লেপিডোচেলিস অলিভাসিয়া) এবং কেম্পস রিডলি (লেপিডোচেলিস কেম্পি)। এরমধ্যে বঙ্গোপসাগরে অলিভ রিডলি, হঙবিল ও গ্রিন টার্টলসহ তিন থেকে পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম শনাক্ত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে অলিভ রিডলি কাছিম ছাড়া অন্য কাছিম ডিম পাড়তে কঙবাজার উপকূলে আসছে না। অলিভ রিডলি ও হঙবিলের প্রজননকাল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। আর গ্রিন কাছিমের প্রজননকাল জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। তবে গত ৫ বছর ধরে কঙবাজার উপকূলের কোথাও হঙবিল বা ভূত কচ্ছপ এবং ৩ বছর ধরে গ্রিন টার্টল বা সবুজ রঙা কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসার তথ্য নেই বলে জানান সমুদ্রবিজ্ঞানীরা।
কঙবাজার সৈকতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাছিম সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজোর্ভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। নেকম কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শফিকের মতে, এক সময় কঙবাজার সৈকতের বিভিন্ন স্থানে ডজন ডজন কাছিমের ‘অ্যারিবদা’ দেখা গেলেও সাম্প্রতিককালে একেবারেই কমে গেছে।
তার মতে, এক দশক আগেও কঙবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা তিন প্রজাতির কাছিমের মধ্যে ৯৯% ভাগই ছিল অলিভ রিডলি টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম। বাকী একভাগ ছিল গ্রিন টার্টল (সবুজ রঙা কাছিম) ও হঙবিল টার্টল (ভূত কাছিম)। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল এক প্রজাতির কাছিমই ডিম পাড়তে আসছে কঙবাজার সৈকতে।
তিনি জানান, জলপাই রঙা রিডলি কাছিম কঙবাজার সৈকতে এবং সবুজ রঙা কাছিম ও ভূত কাছিম সেন্টমার্টিনেই বেশি দেখা যেত। তবে মাঝেমধ্যে হিমছড়ি ও পেঁচারদ্বীপেও সবুজ রঙা কাছিমের দেখা মিলেছে বলে জানান তিনি।
২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে বাংলাদেশে সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষিত প্রজাতি হিসেবে তালিকাভূক্ত। এগুলো শিকার করা, খাওয়া, অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ পরিবহন ও ক্রয়বিক্রয় করা দণ্ডনীয় অপরাধ। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা–আইইউসিএনের তালিকায় বাংলাদেশে সব কাছিমের অবস্থান বিপন্ন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ বিভিন্ন জিনিস খায়, যদিও তাদের বেশিরভাগই জেলিফিশ পছন্দ করে। লেদারব্যাক ও হঙবিল সামুদ্রিক কচ্ছপই বেশি জেলিফিশ খেতে পছন্দ করে। আর এরমাধ্যমে সাগরে জেলিফিশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। যদি সাগরে লেদারব্যাক ও হঙবিল না থাকে, তাহলে জেলিফিশের সংখ্যা বিস্ফোরিত হয়।
তিনি বলেন, জেলিফিশ লার্ভা মাছ শিকার করে। ফলে জেলিফিশ বেড়ে গেলে সাগরে মাছের সংখ্যা কমে যায়। এতে সাগরের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। তবে কচ্ছপের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসাবে বিবেচিত প্লাস্টিক। এরা জেলিফিশ ভেবে প্লাসিক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সাগরে প্রতি ২টি কাছিমের একটি প্লাস্টিক ভক্ষণ করে।
বিজ্ঞানীরা জানান, সামুদ্রিক কচ্ছপ সারা বিশ্বের মহাসাগরে বাস করে এবং কিছু কাছিম ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচে। সামুদ্রিক কচ্ছপগুলি বারনাকল এবং অন্যান্য ছোট ক্রাস্টেসিয়ান, রেমোরাস, শেত্তলা এবং ডায়াটমের মতো ‘জলজ হিচহাইকারদের’ জন্য আবাসস্থল সরবরাহ করে। যেহেতু সামুদ্রিক কচ্ছপগুলি দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। তারা মাছের জন্য ছাতার মতো কাজ করে, যা শিকারীদের থেকে আশ্রয় প্রদান করে। সামুদ্রিক কচ্ছপগুলিও কখনও কখনও সামুদ্রিক পাখিদের অবতরণ করার জন্য একটি বিশ্রামের জায়গা প্রদান করে।