যে পণ্যগুলো দাম বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়, তার মধ্যে খাদ্যপণ্যই ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে চালের অংশ ২৩ শতাংশ। চালের দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দামও বাড়ছে। বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে মূল্যস্ফীতি গড়ের চেয়ে বেশি। চলতি বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে হঠাৎ করে ভিড় বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের বাজারে। বিশেষ করে চাল-ডাল-মসলাসহ কিছু অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে এক লাফে অনেক বেড়ে যায় পণ্যগুলোর দাম। মূল্যবৃদ্ধির এ ধারা বছরজুড়ে চলতেই থাকে। শুধু চাল-ডালের বাজার নয়, একই পরিস্থিতি তৈরি হয় ওষুধ ও চিকিৎসা সেবায়ও যা বাড়িয়ে দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতির কারণ বিশ্লেষণ করছেন, তার মধ্যে চাহিদাও চিহ্নিত করছেন, তার মধ্যে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্যহীনতা, বাজার তদারকি অভাব, সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে অনৈতিক ব্যবসায়িক প্রবণতা। লকডাউনের সময় মানুষের মধ্যে আতঙ্কে অধিক ক্রয়ের প্রবণতা দেখা দেয়। বাজারে পণ্য থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যবসায়ী এ সুযোগে দাম কিছুটা বাড়িয়ে মুনাফা করেছেন সত্য। তবে এর জন্য ব্যবসায়ীদের চেয়ে সরবরাহ ব্যবস্থার বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে বেশি দায়ী করা হচ্ছে। করোনা ও বন্যায় বাজারে চাল সরবরাহ কমে গেছে। অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম হলো, সরবরাহ কমলে দাম বাড়বে। এ দাম বাড়ায় কৃষকের কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রধান নিত্যপণ্য হওয়ায় চালের দামের ওপর গোটা বাজার নির্ভর করে। এছাড়া বন্যায় অনেক সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। ব্যবসায়ীদেরও কারসাজি রয়েছে। যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাব তো আছেই। সবার আগে বাজারে পর্যাপ্ত চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে। সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে দেশে পর্যাপ্ত চাল নেই তাহলে যেটুকু প্রয়োজন ঠিক সেটুকুই আমদানি করবে। বেশি আমদানি হলে বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বন্যা, করোনা, বিশ্ববাজারে টালমাটাল অবস্থা এবং আমদানির ক্ষেত্রে দেশগুলোর শুল্কারোপ মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় অবস্থায় রাখার তাগিদ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকেই। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাজারের কারসাজি নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর বাজার মনিটরিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য যেমন চিকিৎসাসামগ্রী, যাতায়াত ব্যয়, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি মানুষের সক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে সমস্যা সমস্যাই থেকে যাচ্ছে। সংগত কারণেই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহে সামঞ্জস্য রাখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাজার স্থিতিশীল রাখতে হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা-যোগানের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। মূল্যস্ফীতি ঘটতো এমন এক সময়ে, যখন মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। বিবিএসের সেপ্টেম্বরের এক জরিপ অনুযায়ী, করোনা মহামারীর প্রভাবে মানুষের মাসিক আয় ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ কমেছে। মহামারিতে আয় কমে যাওয়ার খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমে গেছে ৫২ শতাংশের মতো পরিবারের। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, শতকরা প্রায় ৬৮ দশমিক ৩৯ ভাগ পরিবার বা খানা কোনো না কোনোভাবে করোনার অভিঘাতে আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে রিকশা বা ভ্যানচালক ও দিনমজুররা অধিক মাত্রায় আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন। এই যখন অবস্থা, তখন আমাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মহামারী করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা। শীতের আগমনে ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। সেসব দেশে বেড়ে চলেছে নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। ইউরোপের কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছে লকডাউন। বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়তে পারে। এতে বিশ্ব আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে। শুধু রফতানি খাত নয়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়লে আমাদের অনেক পণ্য উৎপাদনে কাঁচামালের অভাব দেখা দেবে। তাছাড়া অনেকটা আমদানি নির্ভর খাদ্যপণ্য, যেমন গম ভোজ্যতেল, গুঁড়ো দুধ, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বেশকিছু খাদ্যপণ্যের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। করোনা মহামারীর কারণে মানুষের আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়া দারিদ্র হারে উল্লম্ফন ঘটা এবং করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকারকে এখনই প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে। মূল্যস্ফীতির মূল কারণ সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা ও বিপণন ব্যবস্থার অদক্ষতা। গ্রামে উৎপাদিত কৃষি পণ্য শহরে আসতে আসতে দাম বেড়ে যায়, আর শহরে উৎপাদিত শিল্পপণ্য গ্রামাঞ্চলে যেতে যেতে দাম বেড়ে যায়। বিদ্যমান উপাত্ত অনুযায়ী এই দাম বাড়ার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি। এসব দুর্বলতা ও অদক্ষতা দূর না করে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাবে না। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য গত কয়েক বছর মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় থাকায় সরকার এক ধরনের সন্তুষ্টির মধ্যে ছিল। কিন্তু এখন যেভাবে প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে, তখন আর আগের সন্তুষ্টি নিয়ে আত্মতৃপ্ত থাকার সুযোগ নেই। পণ্যের দাম বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষ তথা নিম্নবিত্ত মানুষই বেশি কষ্ট পায়। তাই সরকারের উচিত বাজার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা। কখন কোন পণ্যের সংকট তৈরি হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেয়া, যাতে বাজারে ভারসাম্য বজায় থাকে।