বলীদের আতুরঘর যেন এখন কুমিল্লা। গতকাল জব্বারের বলীখেলা শুরুর আগে দুই আসর আগের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার শাহজালাল বলী বলছিলেন এবারেও কুমিল্লায় নিয়ে যাবে শিরোপা। অবশ্য শাহজালালের এমন দৃঢ়তার পেছনে যুক্তিও আছে। গতকাল জব্বারের বলী খেলায় অংশ নিতে যে ১২০ জন বলী এসেছেন তার মধ্যে ৪০ জন এসেছেন কুমিল্লা থেকে। যদিও শাহজালালকে চতুর্থ স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তবে তার শীর্ষ বাঘা শরীফ টানা দ্বিতীয়বারের মত জিতেছেন জব্বারের বলী খেলার সেরার মুকুট। জব্বারের বলীখেলার ১১৬ তম আসরের শেষ আটের পাঁচ জন ছিলেন কুমিল্লার। শেষ চারের চারজনই ছিলেন কুমিল্লার। আর ফাইনাল তো গতবারের মত অল কুমিল্লা। নাটকীয়তায় ভরা ৩২ মিনিটের সেই ফাইনাল শেষে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট উঠে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফের মাথায়। আর গত আসরের রানার আপ রাশেদ পারলেন না প্রতিশোধ নিতে। অবশ্য তার সামান্য ভুলে তিনি নক আউট হয়ে গেছেন। বিকেল ৫টা ২৯ মিনিটে শুরু হওয়া ফাইনাল চলে টানা ৩০ মিনিট। এরপর প্রধান বিচারক নতুন আইন ঘোষণা করেন। যেহেতু আলোক স্বল্পতার কারণে ম্যাচ শেষ করতে হবে তাই তিনি ঘোষণা দেন আঁছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে পিঠ লাগাতে হবে না। মাটিতে ফেলতে পারলেই বিজয়ী হবে। এই ঘোষণার দুই মিনিট পর বাঘা শরীফ চড়াও হয়ে খেলতে থাকেন। একপর্যায়ে রাশেদকে কোণঠাসা করে ফেলেন তিনি। কিন্তু রাশেদ নিজেকে বাঁচাতে রিং এর রশি ধরে আত্নরক্ষা করেন। আর সেটি ছিল টেকনিক্যালি ফল্ট। আর সে ফল্টের কারণে বাঘা শরীফকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ২০২৪ সালের পর আরো একবার জব্বারের বলী খেলার শিরোপা জিতে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করলেন কুমিল্লার বাঘা শরীফ।
গত আসরের সেরা চারসহ এবারের আসরে বেশ কয়েকজন সেরা বলী অংশ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে রুবেল চাকমা, রাসেল ভুইয়া, দিপু অন্যতম। প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ শেষে কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য আট জনকে বাছাই করা হয়। সে আটজনের মধ্যে গতবারের চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফের প্রতিপক্ষ ছিলেন কুমিল্লার দিপু। কিন্তু শুরুতেই কুপোকাত দিপু। দ্বিতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে কুমিল্লার কামালের প্রতিপক্ষ ছিলেন বোয়ালখালীর কাঞ্চন। এই ম্যাচে সহজ জয় নিয়ে সেমিতে পৌঁছে যান কামাল। তৃতীয় কোয়ার্টার ফাইনালে শাহজালালের প্রতিপক্ষ ছিলেন সীতাকুণ্ডের রাসেল। যথারীতি সহজ জয় পান শাহজালাল। শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে গত আসরের রানার্স আপ রাশেদের প্রতিপক্ষ ছিলেন রাঙামাটির রুবেল চাকমা। কিন্তু রুবেল চাকমা পারলেন না প্রতিরোধ গড়তে। সেমিফাইনাল ছিল আরো নাটকীয়তায় ভরা। প্রথম সেমিফাইনালে নিজ জেলার কামালকে মাত্রও তিন মিনিটেই নক আউট করে দেন বাঘা শরীফ। তবে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে দশ মিনিট লড়াই করার পর নিজ জেলার রাশেদের কাছে হার মেনে নেন শাহজালাল। ফলে গত আসরের ফাইনালটাই যেন মঞ্চস্থ হয় এবারেও। তবে ফাইনালের আগে কামালের সাথে তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও হেরে যান শাহজালাল। ফলে এক সময়ে দাপুটে বলী শাহজালালকে চতুর্থ স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
এরপর লালদীঘি মাঠের হাজার হাজার দর্শক অপেক্ষা করছিলেন ফাইনালের জন্য। বিকেল ৫টা ২৯ মিনিটে শুরু হয় বহুল কাঙ্ক্ষিত জব্বারের বলী খেলার এবারের ফাইনাল। মাঠে তখন কুমিল্লা কুমিল্লা রব। কারণ মঞ্চে লড়াইরত দুই বলীই যে কুমিল্লার। কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। লড়াই চলছিল শেয়ানে শেয়ানে। ঘামে, বালি আর কাদায় যেন একাকার দুই বলী। জান দেব তবু মান দেব না। দুজনের সংকল্প যেন সোনার হরিণ চাই চাই। কিন্তু চাইলেতো আর হবে না। লড়াই করেইতো জিততে হবে। আধা ঘণ্টা লড়াই চলার পর ম্যাচের প্রধান রেফারি হাফিজুর রহমান জানালেন আই পরিবর্তনের কথা। বললেন আঁছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে পিঠ লাগাতে হবে না। মাটিতে ফেলতে পারলেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। এরপর যেন নব উদ্যমে শুরু করেন শরীফ এবং রাশেদ। তবে ম্যাচের শুরু থেকেই শরীফ ছিলেন আক্রমণাত্নক। রাশেদ কিছুটা রক্ষণাত্নক। কিন্তু সে রক্ষণাত্নক ভঙ্গিটাকে রিং এর রশির সহায়তায় আরো দৃঢ় করতে গিয়ে ধরা পড়েন রাশেদ। তার সে প্রচেষ্টা ধরা পড়ে রেফারির চোখে। ফলে সেটাকে টেকনিক্যাল ভুল হিসেবে ধরা হয়। আর সে ভুলের কারণে আরো একবার কপাল পুড়ল রাশেদের। আরো একবার শিরোপার কাছে এসে ফিরতে হলো খালি হাতে। যদিও রেফারির এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে চাননি রাশেদ। তার মতে তাকে জোর করে হারানো হয়েছে। কিন্তু রেফারির সিদ্ধান্তই যেখানে চূড়ান্ত সেখানে রাশেদের প্রতিবাদ আর ধোপে টিকল না। আরো একবার রানার্স আপ হয়ে ফিরতে হলো তাকে। আর আরো একবার বিজয় কেতন উড়ালেন বাঘা শরীফ। পুরো ফাইনাল আর পুরো প্রতিযোগিতা জুড়ে কুমিল্লা কুমিল্লা রব। তবে এবারের দর্শক উপস্থিতি ছিল অন্য সকল আসরের চাইতে অনেক বেশি। হাজার দর্শকের উদ্দেশ্যে বিজয় উদযাপন করলেন বাঘা শরীফ। বললেন এবার তার লক্ষ্য হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতা।
খেলা শেষে প্রধান অতিথি সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন চ্যাম্পিয়ন রানার্স আপসহ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। চ্যাম্পিয়ন বাঘা শরীফ ট্রফিসহ নগদ পেয়েছেন ৩০ হাজার টাকা। রানার্স আপ রাশেদ ট্রফি ছাড়াও পেয়েছেন নগদ ২০ হাজার টাকা। এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অর্জনকারী পেয়েছেন ট্রফিসহ যথাক্রমে ৬ হাজার এবং ৪ হাজার টাকা। এছাড়া প্রথম রাউন্ডে বিজয়ী ৪০ জনকে দেওয়া হয়েছে ক্রেস্ট এবং নগদ অর্থ পুরস্কার। এবারের জব্বারের বলী খেলায় ১২০ জন বলী নাম নিবন্ধন করলেও সেখান থেকে যাচাই বাছাই করে ৯০ জনকে খেলার জন্য মনোনীত করা হয়। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতার স্পন্সর গ্রামীণ ফোনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বিকেলে প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ। এ সময় প্রতিযোগিতা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান, সদস্য সচিব শওকত আনোয়ার বাদলসহ মেলা কমিটির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।