বাংলায় প্রাচীন মুসলমান পরিবারের ইতিহাস বলা খুব কঠিন কাজ। তাদের অনেকের অবস্থা এতই নাজুক ও পরিবর্তিত হয়েছে যে নিজের গোত্রের মানুষজনও অনেক সময় পূর্বপুরুষ বা বংশ পরম্পরা সম্পর্কে ঠিকভাবে বলতে পারে না। অজ্ঞতা ও দারিদ্র্য তাদেরকে এতই নিচে নামিয়ে এনেছে যে তারা এখন সর্বসাধারণের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রায় সময় অভিজাত ও উচ্চবংশীয় অনেক পরিবার প্রধানকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল জীবন বাঁচাতে। অনেক দূরে কোথাও। সরকার পরিবর্তন বা বিপ্লবের সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যেতে হয়েছিল যেখানে তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করে বসবাস করতে হয়েছিল তাদেরকে। এই ঘটনা শুধু মুঘল আমলে ঘটত তা নয়, সেই আমলের আগে বা পরে প্রতিটি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক পরিবার বা গোত্র প্রধানকে এই ভাগ্য বরণ করে নিতে হতো। এইসব আশ্রিত পরিবারগুলোকে অবনত অবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করতে হতো বিধায় তারা উত্তরসূরীরা প্রাকৃতিকভাবে আগের সেই পারিবারিক শৌর্য হারিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়তো। অনেকগুলো পরিবার তাঁদের পূর্বতন পরিচয় হারিয়ে একেবারে হারিয়ে যেত পরিচয়হীনতায়।
উপরে বর্ণিত বিধবংসী সব অপারেশন থেকে বেঁচে গিয়েছিল এবং নিরাপদে বসবাস করে আসছে, বাংলায় এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। আমরা নিম্নোক্ত কারণে তাদের গণনা করতে পারছি না– ১। সবগুলো পরিবার আমাদের জানাশোনার আওতায় নেই। ২। তাদের সংখ্যা এতই বেশি যে শুধু একটা ক্যাটালগ করতে গেলেও বিশাল একটা ভলিউম পূর্ণ হয়ে যাবে। তবুও আমরা কিছু প্রাচীন মুসলমান পরিবার সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিব। প্রথমত এটা বুঝা দরকার যে মুসলমানদের মধ্যে প্রধানত চারটা গোত্র আছে। ১। সৈয়দ ২। শেখ ৩। মুঘল ও ৪। পাঠান, যাদেরকে মনে করা হয় এই অঞ্চলের মুসলমান ভদ্র–সম্প্রদায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১। সৈয়দ গোত্র অন্য তিনটা গোত্রের চেয়ে মর্যাদার দিক থেকে উপরে। এবং সাধারণত তাদেরকে সবচেয়ে সম্মানিত মনে করা হয়। এই অভিজাত মুসলমান গোত্র আবার দুটি উপভাগে বিভক্ত। প্রথমটা হলো বনী ফাতেমা সৈয়দ, যারা ইমাম হাসান ও হুসেনের বংশধরদের উত্তরসূরী। হযরত আলী ও বিবি ফাতেমার আওলাদদেরকে ফাতেমী সৈয়দ বলা হয়। হযরত আলীর বংশধরদেরকে( বিবি ফাতেমা ও হযরত আলীর সংসারের বাইরে) আল্ভী সৈয়দ বলা হয়। ফাতেমী সৈয়দ আল্ভী সৈয়দের চেয়ে মর্যাদাবান কারণ তাঁরা রাসুলের বংশধর। ফাতেমী সৈয়দের আবার কিছু প্রশাখা আছে। বারো ইমামের অনুসারীরা আলাদাভাবে তাদের নামে পরিচিত; যেমন– হোসাইনী সৈয়দ, হাসাইনি সৈয়দ, মুসাভী সৈয়দ, রযবী সৈয়দ, কাজেমী সৈয়দ, তাকাভি সৈয়দ, নাক্লাভি সৈয়দ ইত্যাদি। একইভাবে কিছু কিছু সৈয়দ আছেন যারা তাঁদের পূর্বপুরুষের নামে নিজেদের নামকরণ করেছেন। যেমন: ইসমাইলি, যাইদী, তবা তবাই, কাদেরি, ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু পরিবারের নামকরণ হয়েছে তারা যেসব এলাকায় বসবাস করে সেগুলোর নামে। যেমন, বুখারী, কারমানি, তাবরেজি, শাব্জারী ইত্যাদি। যাদের মা ও বাবা উভয়ের দিক থেকে সৈয়দ, হাসান ও হোসাইন পরিবারের সাথে সম্পর্কসূত্রে তাদেরকে হাসানি–উল–হোসাইন বলা হয় এবং মর্যাদার দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়ে থাকেন।
২। কোরাইশী শেখ: এই বংশ খুবই সম্মানজনক কারণ আল্লাহর নবী মুহাম্মদ সা. এই বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন। এই বংশের অনেক উপশাখা আছে। প্রত্যেকটি উপশাখা একেকজন সাহাবীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। যেমন, সিদ্দিকি, ফারুকী, ওসমানী, খালেদী, ইত্যাদি। সৈয়দ ও কুরাইশী শেখ আরব বংশোদ্ভুত। ইরান, আফগানিস্তান ও খোরাসানে মহান পীর, বিখ্যাত ও জ্ঞানী বুজুর্গের নামে শেখ পরিবার আছে।
৩। মুঘল: এরা মঙ্গোলীয়ার একটা গোত্র। চেঙ্গিস খান ছিলেন এই গোত্রের সবচেয়ে মহান ও বিখ্যাত রাজা। এই গোত্রের ধর্ম ছিল মূলত পেগান। কিন্তু, চেঙ্গিস খানের এক নাতি ইসলাম গ্রহণের পর এই জাতির গণমানুষ তাদের রাজাকে অনুসরণ করে ইসলাম ধর্মের দীক্ষা নেন। ছাঘতাইয়ের সব রাজা ছিলেন মুসলমান। কারণ ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের আধিপত্য ছিল। এবং এই কারণে এই জাতি ভারতের জনগণের কাছে সম্যক পরিচিত লাভ করে। এই মানুষগুলোর মির্জা বা বেগ পদবী ছিল। এই জাতির অনেকগুলো উপসম্প্রদায় ও উপশাখাও ছিল।
৪। পাঠান: এরা আফগান বংশোদ্ভূত জাতি। এদের মূল কেন্দ্র বা আদিনিবাস আফগানিস্তানে। ভারতে আফগানদের দীর্ঘদিনের কর্তৃত্বের ফলে এই সম্প্রদায়ের লোকজন এখানকার মানুষের সাথে মিশে যেতে পেরেছিল। এদের পদবী হলো খান। এদের অনেক শাখা ও প্রশাখা আছে। এটা যোগ করা দরকার যে এই অঞ্চলের যেসব আদি নিবাসী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা সৌজন্যতা হিসেবে শেখ, খান বা মল্লিক পদবী ধারণ করেছেন।
সম্মানিত ও প্রসিদ্ধ সৈয়দ ও শেখ গোত্রের যারা ঘুর রাজাদের আমলে জনগণের মাঝে ধর্মীয় নির্দেশনা প্রদান ও আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে কাজ করেছেন তাঁদেরকে শাহ বা খন্দকার হিসেবে অভিহিত করা হতো। রাজ দরবারে তাঁদেরকে যথাযথভাবে সম্মান করা হতো। তাঁদের উত্তরসূরীরা বর্তমানেও সেসব ধর্মীয় পদবী ব্যবহার করছেন। খন্দকার উপাধি বা পদবী এদেশের পুরনো অভিধা। ঘুর রাজ্যের সময় থেকে এই পদবী ব্যবহৃত হয় ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের জন্য। মুঘল ও পাঠানদের মধ্যে একটা শ্রেণি আছে মল্লিক। ঘুরী এবং খিলজী আমিররা মূলত এই অভিধা গ্রহণ করতেন। কিন্তু, এই আমিররা মাঝেমধ্যে হিন্দুদের কাউকে এই উপাধি দিয়ে সম্মানিত করতেন। অবশ্যই সেটা ধর্মান্তরিত হওয়ার সম্মাননাস্বরূপ। সুতরাং তারা এবং তাদের উত্তরসূরীরা এই পদবী এখনো ধারণ করেন। একইভাবে কতিপয় ধর্মান্তরিত মুসলমান ও তাদের উত্তরসূরীরা শেখ ও খান পদবী হিসেবে ব্যবহার করতো। শেখ, খান ও মল্লিক পদবীধারীদের মধ্যে উচু ও নীচু বংশের মুসলমান ছিল। চৌধুরী ও কাজী পদবী বিদেশী প্রধান চারটা পদবী; সৈয়দ, শেখ, মুঘল ও পাঠান এর যেকোনো একটার উত্তরসূরী ছিল। তারা এই পদবী ব্যবহারের মূল কারণ হলো তাদের পূর্বপুরুষের কেউ কেউ অফিসিয়ালি উচ্চ পদে আসীন ছিলেন কোনো সময়। এদেশে কিছু কিছু মুসলমান আছেন যাদের আদি নিবাস আরবে, তারা ঠাকুর পদবী ব্যবহার করতেন। নিজেদের অবস্থানগত কারণে সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদেরকে এই অভিধায় ডাকা হতো। ঠাকুর পদবী হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে সম্মানজনক পদবী। অন্যরা, যেহেতু তাদের পূর্ব পুরুষ মূলত হিন্দু ঠাকুর, বিশ্বাস প্রভৃতি পদবীধারী ছিলেন, ইসলাম গ্রহণের পরেও তারা সেগুলো ধারণ করতেন। তাদের উত্তরসূরীরাও সেই পদবী ব্যবহার করেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলায় কিছু কিছু পরিবার আছেন যাদের পূর্বপুরুষ হযরত আদম (আ) এর বংশধর ছিলেন। এদের মধ্যে উচুবংশীয় কিছু কিছু মুসলমান পরিবার ছিল যাদের নারী ও পুরুষ উভয়ই সমমর্যাদার পরিবারের সদস্য ছিলেন। এদের বিয়েশাদি হতো নিজেদের মধ্যে। সম্মান রক্ষার ক্ষেত্রে এরা এতই রক্ষণশীল ছিলেন যে নিজদের আত্মীয়স্বজনের বাইরে আর কাউকে বিয়ে করতেন না।
প্রাচীন বাংলার চারটি অঞ্চল; রাঢ়, বরেন্দ্র, বাগড়ি ও বঙ্গদেশ। এর মধ্যে প্রথম ও শেষটাতে অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলো বসবাস করতেন; বাকি দুটোতে নিচু জাতের মুসলমানরা। খিলজি ও ঘুরী সাম্রাজ্যের উত্তরসূরী মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল রাঢ ও বরীন্দ্র অঞ্চলে। মুঘল শাসনামলে আসা মুসলমানরা বংগদেশ ও বাগরিতে বসবাস করতেন প্রধানত। প্রথম দল বসবাস করতেন মূলত গ্রামে গঞ্জে, পরের দল শহর ও বন্দরে। অধিকাংশ সম্মানিত ও অভিজাত মুসলমান বসবাস করতেন গ্রামে। কারণ আগেও বলা হয়েছে। শহরগুলো সরকার পতন ও ক্ষমতাবদলের মতো দুর্যোগের স্বীকার হতো প্রায় সময়। আরো কারণ হলো রাজকোষ থেকে বরাদ্দ অনুদান আইমা ও মাদাদি–মা’আশ প্রদান করা হতো গ্রামে গঞ্জ এলাকায়। ফলে যারা এই অনুদান বা বরাদ্দ পেতেন তারা নিজেদের জন্য বরাদ্দ সম্পত্তি বুঝে নিয়ে সেখানেই বসবাস করতেন। এই চর্চা শুধু বাংলায় চালু ছিল না। সমগ্র হিন্দুস্থানে এই প্রথা চালু ছিল। ফলে বড় সংখ্যক মুসলমানের বসবাস শুরু হয়েছিল গ্রামীণ এলাকায়। [খন্দকার ফজলে রাব্বি রচিত দি অরিজিন অব দ্য বেঙ্গলী মুসলিম অবলম্বনে]।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, শিক্ষক