বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া অংশীদারত্ব আরো গভীর করার অঙ্গীকার

পুত্রজায়ায় ইউনূস-ইব্রাহিম বৈঠক ৫ সমঝোতা স্মারক সই

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ১৩ আগস্ট, ২০২৫ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সম্পর্ককে আরো গভীর এবং ভবিষ্যতমুখী কৌশলগত অংশীদারত্বে রূপ দেওয়ার অঙ্গীকার এসেছে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক থেকে। গতকাল মঙ্গলবার পুত্রজায়ার পারদানা পুত্রায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে এই দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানিয়েছে, প্রথমে দুই নেতা একান্তে বৈঠক করেন। এরপর দুই পক্ষের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন প্রতিনিধিকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়। পরে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অভিবাসন, জ্বালানি সহযোগিতা, সুনীল অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠকে অংশ নেয় দুই দেশের প্রতিনিধিদল।

প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহমর্মিতার গভীর বন্ধন রয়েছে আমাদের দুই দেশের মধ্যে। মানবসম্পদ, বাণিজ্য এবং জনমানুষের যোগাযোগে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের একটি বিশেষ অংশীদার। খবর বিডিনিউজের।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অধ্যাপক ইউনূসকে মালয়েশিয়ার বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি বাণিজ্য বাড়ানো, প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে সহযোগিতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যৌথ প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।

আটকে থাকা আট হাজারের মতো বাংলাদেশি শ্রমিককে নতুন সহজ নিয়মের আওতায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ দেওয়ায় এবং মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালু করায় একান্ত বৈঠকে আনোয়ার ইব্রাহিমকে ধন্যবাদ জানান অধ্যাপক ইউনূস। মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালু হওয়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা জরুরি প্রয়োজনে দেশে ফিরে আবার ফিরে গিয়ে কাজে যোগ দিতে পারছেন। উভয় পক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করে খরচ কমানো এবং শ্রমিকদের সুরক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে আইন, বিচার ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক ও প্রকৌশলীর মতো দক্ষ পেশাজীবী নিতে মালয়েশিয়াকে অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বোয়েসেল এখন মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনায় সক্ষম। বাংলাদেশ থেকে নিরাপত্তাকর্মী ও কেয়ারগিভার নিয়োগ এবং মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত বা অবৈধভাবে থাকা শ্রমিকদের বৈধ করার উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।

বৈঠকে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেন যে বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখন মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের সমান সামাজিক সুরক্ষা ও সুবিধা পাবেন। তারা বাংলা ভাষায় অভিযোগ দায়েরও করতে পারবেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখায় থাকা প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য গ্রাজুয়েট পাস ভিসারও আবেদন জানানো হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর করার আকাক্সক্ষা এবং সেক্টোরাল ডায়ালগ পার্টনার হওয়ার চেষ্টা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা করেন দুই নেতা। এ বিষয়ে মালয়েশিয়ার সমর্থন প্রত্যাশা করেন প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি কক্সবাজারে আসন্ন রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ক সম্মেলন এবং সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে মালয়েশিয়া সরকারকে আমন্ত্রণ জানান এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি মালয়েশিয়ার ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান।

আলোচনায় উভয় পক্ষ বাংলাদেশমালয়েশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় গতি আনতে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করতে এবং মালয়েশিয়াবাংলাদেশ যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদকে সক্রিয় করতে সম্মত হয়। এছাড়া দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরে বাংলাদেশের তরফ থেকে ওষুধ, ব্যাটারি, জুতা, সিরামিক ও পাটজাত পণ্যের জন্য মালয়েশিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকার সহজ করার অনুরোধ জানানো হয়।

বৈঠকে সুনীল অর্থনীতি ও হালাল শিল্পে মালয়েশিয়ার সহায়তা চায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি ঢাকার বাইরে একটি হালাল ইকোনমিক জোন স্থাপনের পরিকল্পনা তুলে ধরে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করা হয় ঢাকার তরফ থেকে।

দুই দেশ এলএনজি সরবরাহ ও জ্বালানি সহযোগিতা বিষয়ে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারককে স্বাগত জানায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্ষেত্রে অংশীদারত্বের সম্ভাবনা খোঁজার ব্যাপারে একমত হয়। এছাড়া প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি ও পর্যটনে সহযোগিতা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তার শ্রদ্ধার কথা বলেন এবং এশিয়ার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন করার প্রস্তাব দেন।

৫ সমঝোতা স্মারক সই : প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফরের প্রথম দিনে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে প্রতিরক্ষা, জ্বালানি সরবরাহ, ব্যবসা ও অন্যান্য সহযোগিতা সংক্রান্ত পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে হালাল ইকোসিস্টেম, উচ্চশিক্ষা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক মোট তিনটি নোট বিনিময় হয়েছে।

গতকাল পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর তাদের উপস্থিতিতে এসব সমঝোতা হয়। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই করেন মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ খালিদ বিন নরদিন এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ, এলএনজি অবকাঠামো, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও অবকাঠামো নিয়ে সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতায় সই করেন মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী আমির হামজাহ বিন আজিজান এবং জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস) এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে সই করেন আইএসআইএস মালয়েশিয়ার চেয়ারম্যান ফায়েজ আবদুল্লাহ এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসান।

মালয়েশিয়ার মান নিয়ন্ত্রণকারী কোম্পানি এমআইএমওএসের সঙ্গে বাংলাদেশমালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিএমসিসিআই) সহযোগিতার বিষয়ে সমঝোতায় সই করেন এমআইএমওএসের সিইও মোহাম্মদ ফওজি ইয়াহায়া এবং বিএমসিসিআইয়ের শাব্বির আহমেদ খান। ব্যবসায়িক কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এনসিসিআইএম) প্রেসিডেন্ট এন গোবালাকৃষাণ এবং বাংলাদেশের এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক হাফিজুর রহমান সমঝোতা স্মারকে সই করেন।

অনুষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা এবং কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে দুটি নোট বিনিময় করেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উতামা হাজি মোহাম্মদ বিন হাজি হাসান ও পরররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। আর হালাল ইকোসিস্টেমে সহযোগিতার বিষয়ে নোট বিনিময় করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের উপমন্ত্রী জুলকিফলি বিন হাসান ও বিডা চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। আজ বুধবার ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়ার (ইউকেএম) আচার্য এবং নেগেরি সেমবিলান রাজা তুয়াংকু মুহরিয ইবনি আলমারহুম তুয়াংকু মুনাওয়ির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর প্রধান উপদেষ্টাকে একটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি তুলে দেবে ইউকেএম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি স্মারক বক্তৃতাও দেবেন প্রধান উপদেষ্টা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅলিগলি থেকে রাজপথ ব্যাটারি রিকশার দাপট
পরবর্তী নিবন্ধটেকনাফে সাড়ে ৬ কোটি টাকার ইয়াবা ও আইস জব্দ