বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরে কোথাও মিলছে না ডলার। সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দর মানছে না। চড়া দামে দেয়া হচ্ছে এলসি পেমেন্ট। কার্ব মার্কেটে কিছুটা নিম্নমুখী হলেও আমদানি বাণিজ্যে চড়া দামে ডলারের ব্যবহার অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বিলাস দ্রব্যের পাশাপাশি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দরেও ‘ডলারের দাম’ বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে।
বছরের শুরু থেকে ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থায় লাফিয়ে বাড়ছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের শুরু থেকে গত ৫ মাসে ছয় দফায় টাকার অবমূল্যায়ন করেছে। ডলার প্রতি টাকার মান ক্রমাগত কমতে থাকায় অস্থির হয়ে উঠে দেশীয় বাজার পরিস্থিতি। ইন্টারব্যাংক মার্কেট ও কার্ব মার্কেটের ৮৬/৮৭ টাকা থেকে বেড়ে ডলারের দাম ১০২ টাকায় গিয়ে ঠেকে। সর্বশেষ গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বিনিময় হার প্রতি মার্কিন ডলার ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ দশমিক ৯০ টাকা নির্ধারণ করে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলস ফর কালেকশন (বিসি) সেলিং রেটের হার প্রতি ডলার ০.৪০ টাকা বাড়িয়ে ৮৮ টাকা করেছে এবং আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করার সময় ব্যাংকগুলোকে এই হার অনুসরণ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংক মানছে না বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
সূত্র বলেছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান আমদানি এবং ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান দফায় দফায় কমানো হচ্ছে। দেশে ডলারের বিনিময় মূল্য অনেকদিন ধরে ৮৫.৮০ টাকা ছিল। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম টাকার অবমূল্যায়ন করে ডলারের দাম ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এরপর ২৩ মার্চ আবারো টাকার অবমূল্যায়ন করে ডলারের দাম ২০ পয়সা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ৮৬.২০ টাকা। এক মাসের মাথায় ২৭ এপ্রিল আবার ২৫ পয়সা বাড়িয়ে দর নির্ধারণ করা হয় ৮৬.৪৫ টাকা। গত ৯ মে ডলারের বিনিময়মূল্য আবার ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। এরপর গত ১৬ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারপ্রতি বিনিময়মূল্য ৮০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে গত ২৩ মে ডলারের বিনিময়মূল্য ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭.৯০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়।
তবে ব্যাংকগুলোকে বিলস ফর কালেকশন (বিসি) সেলিং রেটের ৮৮ টাকায় লেনদেন করতে বলা হয়। কিন্তু কোনো ব্যাংকে ৮৮ টাকায় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরে ডলার বিক্রি করছে না। তারা ডলারের অবৈধ মজুদ গড়ে তুলছে এবং বাড়তি দরে এলসি পেমেন্ট দিচ্ছে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরের চেয়ে ডলার প্রতি ১০ টাকা বাড়তি দরে ৯৮ টাকায় এলসি পেমেন্ট দেয়া হয়েছে। বাড়তি দরে রাজি না হলে কোনো ব্যাংক এলসি পেমেন্টের ব্যাপারে রাজি হচ্ছে না। ডলার প্রতি ১০ টাকা বাড়তি দেয়ার ফলে আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। ডলার নিয়ে নানামুখী কারসাজি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গতকাল একাধিক ব্যাংক ম্যানেজার বলেন, ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। কথাটি ঠিক। তবে যেভাবে বলা হচ্ছে ঠিক সেভাবে বাড়তি দরে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে না। তারা বলেন, এলসি করার ব্যাপারে একেকটি ব্যাংকের একেক ধরনের সিলিং রয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক ৩০ হাজার ডলার, কোনো কোনো ব্যাংক ৩৫ হাজার ডলার, আবার কোনো কোনো ব্যাংক ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত এলসি পেমেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরে দিয়ে থাকে। এতে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কাস্টমারদের স্বার্থে ক্ষতিটা মেনে নেয়। কিন্তু ওই সিলিংয়ের চেয়ে বড় অংকের এলসির পেমেন্ট আসলে তখন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া দরে পেমেন্ট দেয়া হয় না। তখন ইন্টারব্যাংক কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হারের উপরই ডলারের দর নির্ধারণ করা হয়। গতকাল ৯৮ টাকা দরে এলসি পেমেন্ট দেয়ার কথা স্বীকার করে একাধিক ব্যাংকার বলেছেন, কার্ব মার্কেটে যে দরে ডলার বিক্রি হয় ঠিক সেই দরে ব্যাংকগুলো বড় এলসিগুলোর পেমেন্ট দিয়ে থাকে। ছোট এলসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দর অনুসরণ করা হয় বলে তারা দাবি করেন।
গতকাল একাধিক ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তেল মজুদ রাখার জন্য যদি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে ডলার মজুদের জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। প্রতিটি ব্যাংকে ডলারের মজুদ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তারা।