বিশ্ব শিশুস্বাস্থ্যের গতি–প্রকৃতি:
* পৃথিবী ব্যাপী শিশু মৃত্যুর প্রধান কারণসমূহ–তীব্র শ্বাসতন্ত্রের অসুখ (যেমন নিউমোনিয়া) ডায়রিয়া, হাম, ম্যালেরিয়া ও অপুষ্টি ,কখনোবা এ সবের একত্ররুপ। এসবের মধ্যে নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া মিলে প্রতি বছর ৩ মিলিয়ন শিশু পাঁচ বছর বয়স পুরানোর আগে মারা যায়। অনুর্ধ–৫ শিশু মৃত্যুর সাথে প্রায় এক তৃতীয়াংশে অপুষ্টিগ্রস্থতা জড়িয়ে আছে।
* শিশু মৃত্যুর ৮৩ শতাংশ ঘটে চলেছে আফ্রিকা ও এশিয়াতে, যার এক তৃতীয়াংশ এই দক্ষিণ এশিয়াতে, আর বাকি অর্ধেক হলো সাব– সাহারা আফ্রিকায়। ধনী দেশগুলোতে এই মৃত্যু হার এক শতাংশেরও কম।
* যদিয়ো বিশ্বব্যাপী অনুর্ধ্ব–৫ শিশু মৃত্যু হার সেই ১৯৭০ এর দশক থেকে হ্রাস পাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীর সব দেশে তা সমান গতিতে নেমে আসেনি। উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে এই মৃত্যুহার ২০ গুণের মতো বেশি।
* অনুর্ধ্ব পাঁচ শিশু মৃত্যুর ৬৮ শতাংশ ঘটে প্রথম বছর বয়সেই। এর মধ্যে নবজাতক শিশুর মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে, কেননা ৫ এর কম বয়সী শিশু মৃত্যুর ৪১ শতাংশ ঘটে শিশুর প্রথম ২৮ দিন বয়সের মধ্যে। ৫ এর কমবয়সী শিশু মৃত্যুর ৪০ শতাংশ ঘটে জীবনের প্রথম মাসে। যাদের বেশিরভাগ মারা যায় ঘরে, জন্মের প্রথম সপ্তাহে।
বাংলাদেশের শিশু–স্বাস্থ্যচিত্র:
* বাংলাদেশে নবজাতক শিশু মৃত্যুর হার,২০২৩ অনুযায়ী প্রতি হাজারে ২০। এ জন্য দায়ী অসুখ– স্বল্প জন্ম–ওজনী নবজাতক (জন্ম ওজন ২৫০০ গ্রামের কম), অকাল প্রসব, বার্থ এসফাইয়িকশিয়া (জন্মকালিন শ্বাসরোধ অবস্থা) প্রভৃতি।
* ইনফ্যান্ট মৃত্যুহার দেশে এখন, প্রতি হাজার জন্মে ২১.৫৫ জন (২০২৩ অনুযায়ী)।
* বাংলাদেশে ১৯৯০ সন থেকে বাংলাদেশ পাঁচ বছরের বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমে আসছে। ২০০৮ ’এ – যা প্রতি হাজার জন্মে ছিলো ৬০ শতাংশ ,তা কমে এখন প্রতি হাজার জন্মে ৪৫ জন (২০২৩ অনুযায়ী)।
* বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুতে যেসব অসুখ প্রধানত: দেখা যায়, সেসব হলো– জ্বর (৪০.১%), নিউমোনিয়া(২০.৮%),ডায়রিয়া(৭.৫%),অপুষ্টি(৪৫%), পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রভৃতি।
* শিশু রোগীর প্রায় ৩০–৭০ শতাংশ শিশু বহির্বিভাগে নিয়ে আসা হয়। তাদের অনেককে নিয়ে আসা হয় বেশ দেরি করে। ফলে জরুরী চিকিৎসাসেবা প্রদানের পূর্বে শিশু বহির্বিভাগেই অনেক শিশুর মৃত্যু ঘটে।
শিশু–স্বাস্থ্য সেবার বৈষম্য:
* বিশ্বের বিবিন্ন দেশে,এমনকী একেই দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্টীতে পুষ্ট শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা প্রয়োগে বেশ বৈষম্য পরিরক্ষিত হয়। তার প্রধান কারণ– অর্থনৈতিক। কখনো–বা লোকজ বিশ্বাসের প্রভাব। এর ফলে অনেক মুমূর্ষ শিশু–রোগী আধুনিক জীবনদায়ী চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত থাকে, অপচিকিৎসার শিকার হয়।
* সংস্কৃতি ভেদে শিশুচিকিৎসা: এটা নির্দিষ্ট এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত ধ্যান–ধারণা, বিধি বিধান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সমষ্টি। রোগের কারণ ও তার প্রতিবিধান নিয়ে একেক সমাজে বা পরিবারে এই কালচারের প্রভাব প্রতিফলিত হয়।
শিশু স্বাস্থ্য–সুরক্ষায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাদি: শিশুরএসব জীবনক্ষয় প্রতিরোধ করা সহজ। এবং এসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপনা সামান্য খরচে সামাল দেয়া যায়, যেমন:-
* নিউমোনিয়ার জন্য সময়মতো এন্টিবায়োটিকস্ প্রদান।
* ডায়রিয়াতে খাবার স্যালাইন এর যথাযথ ব্যবহার।
* নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া ও রোটাভাইরাসজনিত ডায়রিয়ার জন্য রোগ প্রতিরোধক টিকাদান কর্মসূচি।
* ওষুধে চুবানো মশারি ও ম্যালেরিয়ার ঔষধ সময়মতো প্রদান।
* নিরাপদ প্রসব, নবজাতক শিশুর নাভির যত্ন ও সঠিক ব্যবস্থাপনা।
* কম্যুনিটি স্বাস্থ্য–কর্মীর প্রশিক্ষণ।
চিত্র: শিশুকে পরীক্ষা করে দেখা
শিশু চিকিৎসকের ভূমিকা: এখনকার সময়ে একজন শিশুচিকিৎসক বহু দেশ ও বহু সংস্কৃতির পৃথিবীতে বাস করেন। তাঁকে সেভাবে শিশুচিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে হয়। ছয় হাজারের এর বেশি ভাষাভাষির বিশ্ব জনসংখ্যার বাস দুইশতের বেশি দেশে। তাদের কেউবা স্থাযীভাবে, কেউবা সাংস্কৃতিক ও অর্থনেতিক স্রোতের টানে দেশ বদল করে জীবনযাপন করছেন।
* সিস্টেম অব কেয়ার: মা বাবা অভিভাবকের কাছে থেকে ঘরে বা পারিবারিক যত্নে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুর সাথে বিশাল প্রভেদ ‘স্পেশাল রিস্ক’ চিলড্রেনদের। যেমন– দুঃখ দারিদ্রে জর্জরিত শিশু, ইমিগ্র্যান্ট শিশু, মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারের শিশু, হোমলেস চিলড্রেন, রাস্তায় ফেলে যাওয়া–ছুঁড়ে দেওয়া শিশু, যুদ্ধ উম্মাদনার শিকার শিশু। তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে একটা ‘সিস্টেম অব কেয়ার’ গড়ে তোলা খুব প্রয়োজন।
* আমেরিকান ও কানাডীয় শিশু চিকিৎসক পরিষদ মনে করেন–শিশুকে টিকাদান বা স্বাস্থ্য চেকআপ ভিজিটে চেম্বারে আনা হলে, শিশু চিকিৎসক যেন শিশুর লেখাপড়ার বিষয়েও খোঁজ নেন। তার বুদ্ধিমত্তা বিকাশে সর্বতোভাবে দিক্–নির্দেশনা দেন। কেননা গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে–০ ৩ বছর বয়সে যে শিশুকে ছবির বই, ছড়া এসব দিয়ে সাহায্য করা হয়, পরবর্তীতে সে লেখাপড়ায় ভালো করে। মূলত: স্কুলে প্রবেশের পূর্ব হতে শিশুর বাক্শক্তি ও ভাষাজ্ঞান অর্জনের ভিত্ পাইয়ে দিতে হয়। এতে করে শিশুর মেধা বিকাশ সহজতর হয়। এমনকী শিশুচিকিৎসক শিশুর পাঠদানের দরকারি বই এর খোঁজ দিতে পারেন, সে সম্পর্কে মা–বাবার সাথে মত বিনিময় করতে পারেন। চাইলে চিকিৎসক তার অফিস কক্ষ এরকম উপযোগী বইয়ে সাজিয়ে রাখতে পারেন।
* মা বাবাকে শিশুর ভিন্ন ভিন্ন বয়সে কিভাবে শিক্ষা দান করতে হবে তা লিখে জানানো। প্রি–নার্সারি বয়সের শিশুকে উচ্চৈস্বরে পাঠদানের আবশ্যিকতা বুঝিয়ে বলা। এতে এ বয়সে শিশুর মস্থিষ্কে থাকা প্রায় ১ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ, উজ্জীবিত হয়। শিশুর মেধাশক্তি বিকাশে জাগরণ ঘটে ট্রিলিয়ন পরিমান পারস্পরিক সংযোগ স্নায়ু–সন্ধির। অন্যথায় জং ধরে অল্প সময়ে এ শক্তি বিলুপ্ত হতে পারে।
* এ সময়ের একজন শিশু–চিকিৎসককে ভিন্ন ভাষাভাষী ও ভিন্ন সংস্কৃতির সন্তানদেরও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করতে হতে পারে। সেজন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি থাকা দরকার। অনেক পরিবারে ধর্মীয় নেতাদের নানা প্রভাব বিরাজ করে। সবকিছুকে গ্রহণযোগ্যতায় রেখে শিশুর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। সাথে শিশুকে স্বাস্থ্য সচেতন করার প্রয়াস চালানো, যেমন– অ্যাজমার শিশুরোগীকে ইনহেলার এর সঠিক ব্যবহার শিখিয়ে দেওয়া, এতে তার ঘন ঘন অসুখে পড়ার ঝুঁকি হ্রাস পায়।
* বর্তমানে প্রতিবছর পাঁচ হাজারের এর ওপর মেডিক্যাল জার্নাল ও তিন মিলিয়ন চিকিৎসা গবেষণাপত্র্ প্রকাশিত হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন শিশু বিশেষজ্ঞ–ও এখন শিশুরোগ ও তার প্রতিবিধান ইন্টারনেট সংযোগে সেকেন্ডের মধ্যে করায়ত্ব করতে সক্ষম। তাতে করে প্রতিটা শিশুকে গবেষণাভিত্তিক এসব অধুনা চিকিৎসাপদ্ধতি প্রদান করার মাধ্যমে আশু নিরাময়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হতে পারে।
লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ; সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।