নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার হলো স্বাস্থ্যসেবা। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮(১)অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টি স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আজকের লেখায় আমরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের নানাবিধ অর্জন আলোচনার পাশাপাশি কতিপয় অসঙ্গতি, অব্যবস্থাপনা এবং আস্থার সংকট নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বঙ্গবন্ধুর সরকার স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। সে সরকার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা এবং অবকাঠামো রেখে গেছেন। ফলে পরবর্তী সরকার সমূহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের পরিকল্পনা শুধু রাজধানী বা শহরকেন্দ্রিক ছিল না; বরং জেলা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম সহ তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, থানা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিলেন। মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের কম বেশি বিস্তার ঘটেছে প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছেন। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবার নেটওয়ার্ক।‘ ১৬২৬৩’ নম্বর ব্যবহার করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান এবং ৯৫ টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন শাখা চালু করা হয়েছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশকে পোলিও এবং ধনুষ্টংকার মুক্ত ঘোষণা, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, উন্নত শিশু স্বাস্থ্য সেবা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ, হাসপাতাল সমূহের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ আধুনিকায়ন, নতুন নতুন হাসপাতাল নির্মাণ ও চালুসহ অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার।
স্বাস্থ্য খাতের বহুমাত্রিক অগ্রগতির ফলে শিশু, নবজাতক এবং মাতৃ মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে; ফলে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২.৮ এ উন্নীত হয়েছে। ৯১.৩ শতাংশ শিশুকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। অনেক বিশেষায়িত হাসপাতালে বিনামূল্যে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, প্রসূতি সেবা, অর্থপেডিক, চোখ, নাক কান গলা, হৃদরোগ, নবজাতক ও অপুষ্ট জনিত সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি, কুষ্ঠ ও অন্যান্য রোগের জন্য ১৪ টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ছাড়াও সব মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট সহ অনেক জেলা হাসপাতালে সি সি ইউ এর চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে পাঁচ বিভাগের ২০ টি জেলার ৭০ টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কমিউনিটি ভিশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি সেন্টারে প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেজ হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে রোগীর যাবতীয় তথ্য পাঠিয়ে ও রোগীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চক্ষু বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা দেন।
এছাড়া আরো অনেক প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে স্বাস্থ্য খাতে আরো অনেক অগ্রগতি দৃশ্যমান হবে। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালিস্ট হাসপাতাল নির্মাণ, ঢাকা মেডিকেল কলেজকে পাঁচ হাজার সজ্জা ও জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালকে ১৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ। এছাড়াও ২০ টি মেডিকেল কলেজের সমপ্রসারণ, সব বিভাগে বার্ন ইউনিট নির্মাণ, ৩৬ টি জেলা হাসপাতাল ও ৩৪টি উপজেলা হাসপাতালের সংস্কার ও সমপ্রসারণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য।
কিন্ত এখন বড় প্রশ্ন হল সরকারের উপরোক্ত নানামুখী পদক্ষেপ এবং অগ্রগতির সুফল জনগণ কতটুকু ভোগ করছেন এবং কতটুকু সন্তষ্ট ?
বলাবাহুল্য, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ সরকারের উপরোক্ত বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ৩ টি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ মোট ১৬ টি আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেছে। এরপরও বাস্তবতা হচ্ছে, রোগী বা জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি কম বেশি ক্ষুব্ধ! তাদের অভিযোগ পাহাড় সম। যেমন: জনগণ মনে করে এবং প্রকাশ করে সরকারের শতনির্দেশনা ও আয়োজনের পরেও হাসপাতালে ডাক্তারেরা ভালোভাবে চিকিৎসা সেবা দেন না, ডাক্তার নার্স ঠিকমতো উপস্থিত থাকেন না, রোগীদের সাথে ভালো ব্যবহার করেন না ইত্যাদি। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে দালালদের খপ্পরে পড়ে ওই একই সরকারি ডাক্তারকে প্রাইভেটে দেখাতে যান; অতঃপর ডাক্তারের উচ্চ ফি, নানারকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা (যেখান থেকে ডাক্তাররা ৪০% কমিশন পেয়ে থাকেন), পরীক্ষা বা টেস্টের ভুল রিপোর্ট আবার পরীক্ষা করানো, ঔষধ কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নানা উপঢৌকন এর বিনিময়ে গাদা গাদা ওষুধ লিখে প্রেসক্রিপশন ভরিয়ে ফেলা, কিছু জিজ্ঞেস করলে রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা ইত্যাদি। এমনকি অনেক ভুক্তভোগী রোগীর দৃষ্টিতে ডাক্তাররা হলেন কসাই! বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আরো যে সব অভিযোগ প্রায়শই অনেক পত্র পত্রিকায় দেখা যায় তন্মধ্যে কয়েকটি হলো: ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি, পরীক্ষা নিরীক্ষার মানহীনতা বা ভুল বল রিপোর্ট, মেয়াদ উত্তীর্ণ রিএজেন্ট এর ব্যবহার, অদক্ষ টেকনিশিয়ানের ছড়াছড়ি , রোগী নিয়ে দালাল ও ডাক্তারদের সিন্ডিকেট ইত্যাদি।
রোগী ও জনগণের এ ধরনের অভিযোগ ও আস্তাহীনতার মাঝে জাতীয় সংসদেও সাংসদদের অভিযোগ করতে শোনা যায়, ‘মানসম্পন্ন চিকিৎসা নেই, চিকিৎসক নেই, নার্স নেই, টেকনিশিয়ান নেই…। এসব কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ সুচিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ছুটছেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে চলে যাচ্ছে।’
অথচ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানিজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন আমাদের স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে তখন আমাদের এক ধরনের দেশপ্রেমহীন, দায়িত্বহীন চিকিৎসকদের ভুলের খেসারত দিচ্ছে পুরো জাতি। অনেক দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞ, প্রথিতযশা চিকিৎসকদের অর্জনকে কতিপয় চিকিৎসকের ভুলের ফলে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দেশের সুনাম। এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয় যে, ডঐঙ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মান সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়া ভুক্ত ৮ টি দেশের মধ্যে শ্রীলংকার অবস্থান ৭৬, এরপর যথাক্রমে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮, ভারতের অবস্থান ১১২ ,পাকিস্তানের অবস্থান ১২২, ভুটানের ১২৪, মালদ্বীপের অবস্থান ১৪৭, নেপালের ১৫০ ও আফগানিস্তানের ১৭৩। এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের মধ্যে সিঙ্গাপুরের অবস্থান ৬, ওমানের অবস্থান ৮ ও জাপানের অবস্থান ১০।
অপরদিকে যুক্তরাজ্যের অবস্থান ১৮, কানাডার অবস্থান ৩০, অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ৩২ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৩৭। আমাদের পার্শ্ববর্তী এশিয়ার রাষ্ট্র থাইল্যান্ডের অবস্থান ৪৭ ও মালয়েশিয়ার অবস্থান ৪৯। পরিশেষে বলতে চাই, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপ এর ফলে বাংলাদেশের যে অর্জন এবং সেই অর্জনের স্বীকৃতি ডব্লিউ এইচ ও বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদেরকে দিয়েছে, জনগণের আস্থা হীনতা বা অসন্তোষের কারণে তা যেন ভূলুণ্ঠিত না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকেই বিশেষ করে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ব্যক্তি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, চিকিৎসকসমাজ ও কর্তৃপক্ষকে একটু নজর দিতে হবে। অর্থ উপার্জনকে মুখ্য না ভেবে চিকিৎসা সেবাকে মুখ্য ও পবিত্র দায়িত্ব ভাবেন। জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারলে চিকিৎসার জন্য বিদেশ নির্ভরতা যেমন কমবে তেমনি অদূর ভবিষ্যতে সিঙ্গাপুরের মত চিকিৎসা ট্যুরিজম বাংলাদেশের উপার্জনের একটা খাত হতে পারে।
লেখক: অধ্যক্ষ, কায়সার নীলুফার সিটি করপোরেশন কলেজ; প্রধান উপদেষ্টা, রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।