বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ

ড. নারায়ন বৈদ্য | মঙ্গলবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ

দারিদ্র্য শব্দটি অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভোক্তা, সমাজ, তথা দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে অর্থনীতি আলোচনা করে। একজন মানুষের পরিপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ, জীবনযাত্রা, এমন কী সামাজিক মর্যাদাও নির্ভর করে আর্থিক অবস্থার ওপর। আবার প্রতিটি অর্থনীতিতে, বিশেষ করে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের সকল মানুষ সমান সুযোগ পায় না। সমমেধা সম্পন্ন হলেও সকল ব্যক্তি সমাজে সমসুযোগ সুবিধা পায় না বলে সমাজে আর্থিক দিক থেকে কেউ হয়ে যায় দরিদ্র আর কেউ হয়ে যায় ধনী। এজন্য পুঁজিবাদী অর্থনীতির শিরোমণি ইউরোপের প্রতিটি দেশে যেমন বিপুল অট্টালিকায় অতি জৌলুসপূর্ণভাবে কিছু লোক বাস করে তেমন এই বিশাল অট্টালিকার ছায়াতে গৃহহীন নরনারীকেও দেখা যায়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা এটাকে একটি স্বাভাবিক অবস্থা বলে ধরে নিয়েছেন। ১৯৭০ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল এন্তোনী স্যামুয়েলসন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ইকোনমিক্স (ঊপড়হড়সরপং) এর মুখবন্ধে একটি উদাহরণে উল্লেখ করেন যে, একজন ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় তাঁর সন্তানকে বাঁচানোর জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিলে ডাক্তার তাঁকে একটি ঔষধের নাম লিখে দিয়ে বলেন, এ ঔষধটা আপনার সন্তানকে প্রয়োগ করতে পারলে আপনার সন্তান বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পিতা সন্তানের আরোগ্য লাভের আশায় ঔষধের দোকানে গেলেন। দোকানীকে জিজ্ঞাস করলেন, ঔষধের দাম। কিন্তু ঔষধের দামের সমপরিমাণ অর্থ পিতার কাছে না থাকাতে তিনি ঔষধটি ক্রয় করতে পারেননি। তাঁর সন্তানটি মারা যায়। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে লেখকের প্রশ্ন হচ্ছে যে, সন্তানের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, নাকি ঐ পিতা, যার নিকট ঔষধ ক্রয়ের পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন এর উত্তরে বলেন যে, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা দায়ী নয়, বরং ঐ দরিদ্র পিতাই দায়ী। কারণ ঐ দরিদ্র পিতা সমাজে পর্যাপ্ত ক্রয় ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অনেক প্রকার তত্ত্বের ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেক সুন্দর সুন্দর কথাও রয়েছে। আসলে প্রকৃত অবস্থায় পুঁজিবাদী সমাজে যেসব ব্যক্তির বা ভোক্তার পর্যাপ্ত অর্থ নেই অথবা পর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি তারা ঐ যে অট্টালিকার নিচে গৃহহীন নরনারী। আর তারাই দরিদ্র। উন্নত বিশ্বে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পরিমাণ কততা সহজেই প্রকাশ করা হয় না। শুধু প্রকাশ করা হয় অনুন্নত বিশ্বের। বাংলাদেশ যেহেতু অনুন্নত বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ সেহেতু বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিয়ত উন্নত বিশ্ব তথ্য প্রকাশ করে। তাছাড়া আমাদের নিজস্ব প্রাক্কলনের জন্য আমাদেরকে নিয়মিত দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করতে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশে দারিদ্র্যের তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। উক্ত তথ্যে সমগ্র বাংলাদেশের সব জেলা, উপজেলা ও থানার দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখ আছে। অবশ্য বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি আলোচনা করার পূর্বে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্য বলতে বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোর জন্য অধীনস্থ সম্পদ বা আয়ের অপর্যাপ্ততাকে বুঝায়। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্যের সংজ্ঞায় বলেছে যে, দৈনিক এক দশমিক নব্বই ডলারের কম আয় করা মানুষ দরিদ্র বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অতি সম্প্রতি দারিদ্র্যের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। এ সংজ্ঞা অনুসারেপণ্য ও সেবা কেনার জন্য একজন মানুষের প্রতি মাসে ৩ হাজার ৮২২ টাকা খরচ করার সামর্থ্য না থাকলে তিনিই দরিদ্র।

আবার অর্থনীতিতে দারিদ্র্য রেখার মাধ্যমে সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট মানদণ্ডে একটি রেখা টেনে বলা হয় যে, এ রেখার নিচে অবস্থান করলেই তিনি দরিদ্র। ঐ রেখাকে কয়েকটি মানদণ্ড ধরে নিয়ে বিবেচনা করা হয়। যদি বিবিএস এর সংজ্ঞাকে যথাযথ ধরে নিয়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য অবস্থাকে বিবেচনা করা হয় তবে সার্বিক একটি চিত্র পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সমগ্র বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশ (২০২৪ সালের তথ্য অনুসারে) হলেও জেলা, উপজেলা, ভিত্তিক বিশ্লেষণে দারিদ্র্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দরিদ্র জেলা হচ্ছে নোয়াখালী। এখানে দারিদ্র্যের হার মাত্র ৬ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ জন ব্যক্তির মধ্যে দরিদ্র হচ্ছে ৬ জন যারা দারিদ্র্য রেখার নিচে অবস্থান করে। আর যদি থানা ভিত্তিক বিশ্লেষণ করা হয় তবে রাজধানী পল্টন থানা এলাকায় দারিদ্র্যের সংখ্যা হয় মাত্র ১ শতাংশ। ইহার অর্থ হলো যে, ঢাকার পল্টন থানায় ১০০ জন লোকের মধ্যে মাত্র একজন দরিদ্র। রাজধানী ঢাকার কম দারিদ্র্য হার সম্পন্ন অন্যান্য থানাগুলো হচ্ছে বিমানবন্দর, ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট, উত্তরা পশ্চিমে, শাহবাগ। এসব থানায় দারিদ্র্যের হার ২ শতাংশের কম।

আর চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলায় ১৫টি উপজেলা ও ১৫টি থানা রয়েছে। তৎমধ্যে আনোয়ারা উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৩৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। ইহার অর্থ হলো যে, ১০০ জনের মধ্যে আনোয়ারা উপজেলায় ৩৪ জনেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে বা গরিব। আনোয়ারা উপজেলার মোট জনসংখ্যার পরিমাণ হয় ৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৮ জন। অর্থাৎ আনোয়ারা উপজেলায় দারিদ্র্যের পরিমাণ অধিক। অপরপক্ষে চট্টগ্রাম জেলার উপজেলা ও থানার মধ্যে সবচেয়ে ধনী ডবলমুরিং থানা। এ থানায় দারিদ্র্যের হার হয় ২ শতাংশেরও কম।

বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো দরিদ্র জেলা হিসেবে পরিচিত। মন্দার কারণে ঐ অঞ্চলের জেলাগুলোতে দারিদ্র্যের হার বেশি। তবে বিবিএস এর তথ্য অনুসারে এসব জেলাগুলোর দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। আট বছর আগে কুড়িগ্রাম ছিল দেশের অন্যতম দরিদ্র জেলা। আর কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলা ছিল দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। বর্তমানে কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের হার ৩১ শতাংশের বেশি। আট বছর আগে ছিল ৭১ শতাংশ। ঐ সময় দেশের শীর্ষ ১০টি দরিদ্র জেলার মধ্যে ৫টি ছিল রংপুর বিভাগে। জেলাগুলো ছিল কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। এই পাঁচটি জেলার এখন দারিদ্র্যের হার কমে ২০ থেকে ৩১ শতাংশের মধ্যে। কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলার দারিদ্র্যের হার এখন সাড়ে ৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৬ সালের হিসেবে ওই উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ।

বিবিএস এর জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্যের হার এমন পাঁচটি জেলা হলো মাদারীপুর, নরসিংদী, পিরোজপুর, কিশোরগঞ্জ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বিবিএস তথ্যে আরো জানা যায়, নরসিংদী জেলার দারিদ্র্যের হার ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া দারিদ্র্যের হার পিরোজপুরে ৩৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ। গত এক যুগে মাদারীপুর, নরসিংদী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারিদ্র্যে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, নদী অববাহিকার জেলাগুলোতে তুলনামূলক দারিদ্র্যের হার বেশি।

সবচেয়ে কম দারিদ্র্য এমন পাঁচটি জেলা হলোনোয়াখালী, ঢাকা, মেহেরপুর, খুলনা ও ফেনী। ঢাকা জেলার দারিদ্র্যের হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া মেহেরপুরে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, খুলনায় ১০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ফেনী জেলায় সাড়ে ১০ শতাংশ দারিদ্র্যের হার। গত এক যুগে এই পাঁচটি জেলার দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশের দারিদ্র্যে পরিস্থিতি পূর্বের তুলনায় কিছুটা উন্নতি ঘটলেও পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে এ হার কিছুটা বাড়তে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সাবেক অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা ও সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা
পরবর্তী নিবন্ধডা. মোঃ আলী মারুফ