ফানুস উৎসবে আকাশ রাঙানোর পর এবার কল্পজাহাজ ভাসানোর আনন্দে মেতেছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। প্রবারণা উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার রামুর বাঁকখালী নদীতে চলে কল্পজাহাজ ভাসানোর উৎসব। অপূর্ব কারুকাজে তৈরি একেকটি দৃষ্টিনন্দন জাহাজ নৌকায় বসিয়ে ভাসানো হয় নদীতে। সেই জাহাজে চলে শত শত মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। নদীর দুইপাড়েই উৎসব–আনন্দে মাতে হাজারো নর–নারী। গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীর পূর্ব রাজারকুল ঘাটে আয়োজন করা হয় শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কল্প জাহাজ ভাসানো উৎসব। দুপুরে শুরু হওয়া এ উৎসব বিকেল গড়াতেই বর্ণিল হয়ে ওঠে।
বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে যুগ যুগ ধরে বাঁকখালী নদীতে কল্প জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন হয়ে আসছে। এবার ভাসানো হয় পাঁচটি কল্প জাহাজ।
কক্সবাজার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলা সদর পার হয়েই বাঁকখালী নদীর ঘাট। বিকেল ৩টায় এ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, লোকে লোকারণ্য নদীর দুই পাড় গান–বাজনা, কীর্তন ও ফানুস ওড়াউড়িতে মেতে উঠেছে বিভিন্ন বয়সের নারী–পুরুষ। পাঁচ থেকে ছয়টি কাঠের নৌকার ওপর বসানো হয়েছে একেকটি কল্প জাহাজ। আবার ইঞ্জিন নৌকাও দেখা গেল দুটি জাহাজে। মূলত বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজে রঙের কারুকাজে হাঁস, ময়ুর, হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এসব কল্প জাহাজ। চমৎকার নির্মাণ শৈলী আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রতিটি জাহাজই যেন নিজস্ব স্বকীয়তায় পূর্ণ। এসব ভাসমান জাহাজে চলে বৌদ্ধ কীর্তন। কেউ নাচে, কেউ গায়, আবার কেউ ঢোল, কাঁসাসহ নানা বাদ্য বাজায়।
চট্টগ্রাম থেকে প্রবারণায় শ্বশুরবাড়ি আসেন পূজা বড়ুয়া। তিনি বলেন, প্রায় সময় চট্টগ্রামেই প্রবারণা উদযাপন করি। উৎসব বলতে গেলে ওখানে শুধু ফানুস ওড়ানো হয়। কিন্তু এই জাহাজ ভাসানোর আনন্দ সত্যিই অতুলনীয়।
কলেজছাত্রী প্রেরণা বড়ুয়া স্বস্তি বলেন, এটি আমাদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসব মূলত বৌদ্ধদের হলেও প্রতি বছর এটি অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলায় পরিণত হয়।
চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক সংগীত বড়ুয়া বলেন, যুগ যুগ ধরে আমরা এ উৎসব উদযাপন করে আসছি। জাহাজ ভাসানোর প্রায় ১৫–২০ দিন আগে থেকে বৌদ্ধ গ্রামগুলোতে জাহাজ তৈরীর আনন্দ শুরু হয়। বিশেষ করে গ্রামের শিশু–কিশোরেরা এ উদ্যোগ নিয়ে থাকে। প্রতিবছর প্রবারণার পর দিন আমরা বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসানোর আনন্দে মেতে ওঠি।
উৎসবে আসা রামু সরকারি কলেজের শিক্ষক মানসী বড়ুয়া বলেন, শত বছর ধরে চলে আসা এই উৎসব আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার তাগিদ দেয়। এই উৎসব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হলেও সবার অংশগ্রহণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনমেলায় পরিণত হয়।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে থেকে এ জাহাজ ভাসা উৎসবের প্রচলন হয় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। সে দেশের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম এ উৎসবের আয়োজন করেন। শতবছর ধরে রামুতে মহাসমারোহে এ উৎসব হয়ে আসছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া। উদযাপন পরিষদের সভাপতি মিথুন বড়ুয়া বোথামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন কক্সবাজার–৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক লুৎফর রহমান কাজল।