চট্টগ্রামের কান্নার প্রতি
কর্ণপাত করুন
চট্টগ্রাম শহরের আয়তন আগের চাইতে অনেক বিস্তৃত হয়েছে। শহরের ভিতরে ইপিজেড ও শিল্প এলাকার সংখ্যা একাধিক। আবাসিক এলাকাগুলিতে বহুতল ভবনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাটও সম্প্রসারণ হয়ে গিয়েছে। চট্টগ্রামের লোকসংখ্যাও বেড়েছে। পূর্বের মিউনিসিপ্যালিটি এলাকা যতটুকু বিস্তৃত ছিল বর্তমান সিটি কর্পোরেশন এলাকা তার তুলনায় বড়ো হয়েছে। চট্টগ্রামে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। বন্দরের কার্যক্রম বেড়েছে। রাস্তায় ভারী যানবাহনও বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম শহরে বসবাসকারী মানুষের জন্য বিনোদনের স্থানের অভাব রয়েছে। খোলামেলা জায়গার পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আগে ফয়েসলেকে যাওয়া যেতো। এখন সেখানে টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় শিরিষতলা নামক স্থানে এখনো শতবর্ষী বৃক্ষে আচ্ছাধিত খোলামেলা স্থান থাকায়, পাহাড়ঘেরা ওই জায়গায় মানুষ অবসর সময় কাটানোর জন্য যায়। সাংস্কৃতিক কর্মীরা সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই জায়গাকে সাধারণ মানুষ চট্টগ্রামের ফুসফুস বলে অভিহিত করে। সিআরবি এলাকার শতবর্ষী গাছগুলিতে প্রায় ১৯০ প্রজাতির বিপন্ন পাখি এবং অনেক প্রজাতির কীটপতঙ্গ তাদের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। পত্রপত্রিকার খবর থেকে জানতে পারি যে সিআরবি এলাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এই এলাকাটিতে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত যে ভবনগুলি রয়েছে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের অনেক স্মৃতি এই এলাকাতে রয়েছে। এই নান্দনিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানটিতে স্থাপনা নির্মাণ না করার জন্য চট্টগ্রামের জনগণের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন দাবী তুলেছে। চট্টগ্রামের ১৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির দেওয়া বক্তব্যে সিআরবি এলাকার নান্দনিক সৌন্দর্য্য নষ্ট না করে রেলের অন্য কোন জায়গাতে হাসপাতাল নির্মাণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। শতবর্ষী গাছগুলি কেটে ফেলার ব্যাপারে পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। আমি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে প্রতিবেদন এবং আলোচনা অনুষ্ঠান দেখেছি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে জনতার ঐক্য চাই শীর্ষক নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সুজন পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছেন শিরিষতলাকে কেন্দ্র করে বাঙালির সংস্কৃতির যে মিলনমেলা সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে বানচাল করা যাবে না। সিআরবি চট্টগ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকা। ব্রিটিশ আমলের ভবন, আঁকাবাকা রাস্তা, পাহাড়, টিলা ও শতবর্ষী নানা প্রকারের গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ এলাকাটি। যান্ত্রিক জীবনে হাঁপিয়ে উঠা নগরবাসী একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ছুটে যান সেখানে। এই এলাকার পরিবেশ নষ্ট হলে তা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে না। আমি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতা, পরিবেশবাদী ব্যক্তিত্ব, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশিষ্টজনদের সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, চট্টগ্রামের মানুষের স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার এ স্থানটি এবং এর শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়ী চড়াই উৎরাই অক্ষত রাখা হোক। চট্টগ্রাম শহরে বন্দর কেন্দ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং শিল্পকারখানা স্থাপনের পরিমাণ বেড়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মিত হলে আনোয়ারা উপজেলাও শহরে পরিণত হবে। কালক্রমে বোয়ালখালী এবং পটিয়াও শহরে রূপ নেবে। হাটহাজারীর দিকেও শহর সম্প্রসারিত হবে। পতেঙ্গা থেকে ভাটিয়ারি পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতও বে-টার্মিনাল নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের কারণে ফাঁকা থাকবেনা। শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের গতি বাড়লে শহরের জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। শহরের খোলা স্থানগুলি আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আগ্রাবাদ এলাকায় জাম্বুরী মাঠ খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। সেটা এখন পার্কে পরিণত হয়েছে। সার্কিট হাউসের সামনে পাহাড়ী ঢালু মাঠ এখন হয়েছে পার্ক। ফয়েসলেকও পার্কে পরিণত হয়েছে। সিআরবি এলাকাটিতে স্থাপনা নির্মিত হলে চট্টগ্রামে আর খালি জায়গা থাকবেনা। ঢাকায় রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও বিভিন্ন পার্ক রয়েছে। চট্টগ্রামে তেমন স্থান আর থাকবেনা।
আমি চট্টগ্রাম শহরের আদি বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে আমবাগান, টাইগারপাস ও সিআরবি এলাকার অতীত সৌন্দর্য্য দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। হালিশহরের আমাদের পৈত্রিক বাড়ি থেকে খালি চোখে বাটালী পাহাড়ের চূড়ার কাটা অংশটি দেখা যেতো। আমবাগান থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত জায়গাটিও খুব সুন্দর ছিল। দেওয়ানহাট ব্রীজের পশ্চিম দিকে যেখানে রেলের স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে সে জায়গাটি খালি ছিল। দেওয়ানহাট ব্রীজও তখন নির্মিত হয়নি। ব্রীজের সামান্য পশ্চিম দিকে রেললাইনের উপর দিয়ে বর্তমান শেখ মুজিব রোড তৎকালীন জিন্নাহ রোড টাইগারপাসের রাস্তার সাথে মিলিত হয়েছিল। বর্তমান শেখ মুজিব রোড (জিন্নাহ রোড) তখন খুব সরু একটি রাস্তা ছিল। যান্ত্রিক গাড়িঘোড়া কম চলতো। এমনকি রিঙা, অটোরিঙাও কম ছিল। গরুর গাড়ি এবং সাইকেল চলতো। দেওয়ানহাট ছিল একটি সাপ্তাহিক হাট এবং গরুর বাজার। এই বাজারের উত্তর দিকে আমবাগান থেকে আসা রাস্তাটি সিআরবির ভিতর দিয়ে বর্তমান এম.এ.আজিজ স্টেডিয়াম তৎকালীন নিয়াজ স্টেডিয়াম পর্যন্ত গিয়ে এখন যেখানে রেডিসন হোটেল আছে সেদিকে গিয়েছিল। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনসহ বিপ্লবী কর্মকান্ডগুলির স্মৃতি ঐ জায়গাতে রয়েছে। পুরাতন সার্কিট হাউসকে নিয়ে পশ্চিমে ইস্পাহানী বিল্ডিং পর্যন্ত এলাকাটি দারুন সুন্দর ছিল। সিআরবি এলাকার সৌন্দর্য্যে মোহিত হয়ে বিদেশীরা চট্টগ্রামের নাম দিয়েছিল ‘বিউটি কুইন অব দি ইষ্ট’। আপনি পুরাতন সাকির্ট হাউসের স্থাপত্যশৈলী দেখুন, সিআরবির পাহাড়ের ভবনের স্থাপত্যশৈলীগুলি দেখুন, এখানে আপনি ব্রিটিশ বাংলার দুইশ বছরের ইতিহাসের হাসিকান্নার শব্দ শুনতে পাবেন। বাটালী পাহাড়ের সৌন্দর্য্য রক্ষার জন্য আমরা কখনো চিন্তাভাবনা করিনি। এমনকি আপনি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের উঁচু পাহাড়ে উঠে পর্তূগীজ ভবনের স্থাপত্যশৈলী দেখে আসুন। সেখানে আপনি ব্রিটিশরা আসার আগের ইতিহাসের ধ্বনি প্রতিধ্বনি শুনতে পাবেন। ইতিহাস সম্পর্কে নির্বিকার মানুষেরা ইতিহাসের এই সকল সাক্ষীকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করতে পারে।
আপনি যদি চট্টগ্রাম শহরকে গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে আপনি দেখতে পাবেন এই শহরের বড়ো একটি অংশ রেলের মালিকানায় রয়েছে। শহরের দক্ষিণ অঞ্চল রয়েছে বন্দরের মালিকানায়। আপনাদের মধ্যে যারা বয়স্ক মানুষ তারা হয়তো জানেন একসময় চট্টগ্রাম বন্দর এবং রেলওয়ে একসাথে পরিচালিত হতো। পরে পোর্ট এবং রেলওয়ে আলাদা হয়ে যায়। সম্ভবত এটি হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। সিআরবির মূল ভবনটি একসময় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার ছিল বলে শুনেছি। এটি ব্রিটিশ আমলের কথা। আমরা যদি ফৌজদারহাট থেকে শুরু করি, ফৌজদারহাট থেকে পাহাড়তলী এবং পূর্বেকার পাঞ্জাবী লেইন, ফয়েসলেক এলাকার পুরো পাহাড়গুলি সবই রেলের মালিকানায় রয়েছে। পাহাড়তলী থেকে টাইগারপাস হয়ে সিআরবি এলাকাটিও রেলের মালিকানায় রয়েছে। জাকির হোসেন রোডের পাশে চক্ষু হাসপাতাল, ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, ইউএসটিসি ও বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়েল হাসপাতাল যে পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে পাহাড়গুলিও রেলওয়ের। রেলওয়ের কাছ থেকে সম্ভবত লীজ অথবা টেন্ডারের মাধ্যমে কিনে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলি করা হয়েছে। হালিশহরে রেলের একটি বিশাল ইয়ার্ড রয়েছে। তার আশেপাশে রেলের খালি জায়গাও আছে। সেখানে শরীরচর্চা কলেজ, মহিলা পলিটেকনিক কলেজ, হোম ইকোনমিঙ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে আরো খালি জায়গা রয়েছে। এখনো পর্যন্ত রেলের মালিকানায় চট্টগ্রাম শহরের বড়ো একটি অংশ রয়েছে। সরকার একসময় উন্নয়নের কথা বলে জনগণের জমি হুকুমদখল করতো। এখন সেভাবে শহরের জমি হুকুমদখল করলে মানুষ বাস্তুহারা হয়ে শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। অবশ্য বর্তমান সরকার জনগণের জমি হুকুম দখলের ব্যাপারে সুষ্ঠু নীতি অনুসরণ করে থাকেন এবং জমির মালিককে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেন। অথবা তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জমি হুকুম দখল করার নীতি প্রশংসার দাবী রাখে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এবং ষাটের দশকে চাঁটগাবাসীর কাছ থেকে যে সকল জমি হুকুমদখল করা হয়েছিল তার জন্য ক্ষতিগ্রস্তরা কিরকম ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল তা আপনারা ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখতে পারেন। ১৯৬৫ সালে আজ থেকে ৫৬ বছর আগে মধ্যম হালিশহরের বিশাল এলাকা ওয়াসা স্যুয়ারেজ প্রকল্পের জন্য হুকুমদখল করেছিল। তখন জমির মালিকেরা কানি (২০ গন্ডা) প্রতি কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল তা শুনলে আপনার হাসি পাবে। সে জায়গা এখনো খালি পড়ে আছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। নিয়ম অনুসারে এই জায়গাগুলি পূর্বের ভূমি মালিককে ফেরত দেওয়া উচিত।
আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ ছিল, সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নষ্ট না করা এবং এই ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতা ও পরিবেশবাদীদের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামে একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করতে চান এ ব্যাপারে আমরাও তাদের সাথে একমত। চট্টগ্রামের মানুষকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে হবেনা-এটি ভালো খবর। আমাদের অনুরোধ হলো, রেলের হাতে অনেক জমি আছে তার যেকোন একটিতে হাসপাতাল নির্মাণ করে সিআরবি এলাকার সৌন্দর্য্য সুরক্ষা করা হোক। আশা করি বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট।