২৫শে মার্চ আমাদের জন্য ছিল একটি ভয়াবহ নৃশংস হত্যাকাণ্ড বা গণহত্যা দিবস। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে, স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা চট্টগ্রাম এবং দেশের অন্যান্য স্থানে পৌঁছে দেন। তারপর থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ যাতে বাংলাদেশের আপামর জনগণ অংশগ্রহণ করে। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যারা ১৯৭১ সালে কিশোর বয়সী বা তরুণ বয়সের ছিলেন তাদের কাছে এখন বৃদ্ধ বয়সে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। এটি অত্যন্ত কষ্টদায়ক যন্ত্রণাদায়ক এক বেদনা, যদিও স্বাধীনতা মুক্তি ও বিজয়ের স্বাদ মানুষ যতদিন স্বাধীন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন ভোগ করতে পারবে।
আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করি এবং ১৯৭৫ সালে তার পরিবারের শহীদ সদস্যদেরকেও স্মরণ করি এবং তাদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি। ২০২৪ সালের ২৬ শে মার্চের দিনটি আমার জন্য একটি বিশেষ দিন কারণ দুদিন আগে একটি পত্র মারফত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আমাকে জানিয়েছেন যে এ বছরের সিটি কর্পোরেশন এর স্বাধীনতা সম্মাননা পদকের জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়েছে এই পদক দেয়া হবে শিক্ষায় অবদান রাখার জন্য। তিনি ২৬শে মার্চ বেলা তিনটায় পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আমাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে সক্রিয় কাজকর্ম থেকে আস্তে আস্তে সরে আসতে থাকি চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োজিত থাকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষের পদ থেকে ফিরে আসি। আমি ২০১৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাইরে যাওয়া আসা কমিয়ে দিয়েছি বয়সের কারণে এবং স্বাস্থ্যগত কারণে আমার এই চলাফেরার বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে আমার সাথে বিভিন্ন ধরনের সংগঠন বা মানুষজনের যোগাযোগ কমেছে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উদ্যোক্তারা আমাকে ডাকলেও আমি যাই না। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আমাকে পদক প্রদানের জন্য মনোনীত করায় আমি কৃতজ্ঞ এবং উনার প্রতি আমার তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচার বিমুখ মানুষ এবং আমার কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য আমি ফলাও করে প্রচার করার পক্ষপাতি নই। আমার কোনো কাজ মানুষের উপকারে আসলে আমি আনন্দ অনুভব করি কিন্তু তার প্রতিদান নেওয়ার কোনো চেষ্টা আমি করি না। সুতরাং কোন সম্মাননা বা রাষ্ট্রীয় পদক অথবা কোন সংস্থার কোন স্বীকৃতি আমার প্রয়োজন আছে এটা আমি মনে করি না।
আমি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি এবং আরো সংস্থার উন্নয়নের জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছি। যেমন বাংলাদেশ স্কাউটস, রোভার স্কাউটস, বাংলাদেশের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, জেলা, বিভাগীয় এবং জাতীয় স্কুল এবং মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাংগঠনিক কাজে অংশগ্রহণ করেছি। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি দায়িত্ব পালন করেছি এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছি। যদি সেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য কিছু বলার মত থাকে তাহলে সেটা মানুষ বলবে বা ভুক্তভোগীরা বলবে বা উপকার ভোগীরা বলবে আমি ওসব বিষয়কে ফলাও করে প্রচার করি না।
১৯৬৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময় থেকে আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়ি। তারপর থেকে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে আমি নিরলস ভূমিকা পালন করি। বিশেষ করে ১৯৬৬ সাল থেকে ছয় দফা আন্দোলনে একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করি। চট্টগ্রামে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা এম. এ. হান্নান সাহেব শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তখন চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী একমাত্র স্বনামধন্য শ্রমিক নেতা হিসেবে শ্রমিকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। হান্নান সাহেব বিভিন্ন শ্রমিক জনসভায় যাওয়ার সময় আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন। সুতরাং আমার সেই দিকেও কিছু অভিজ্ঞতা ছাত্র জীবন থেকে রয়েছে।
বিশেষ করে বন্দর এবং তেল সেক্টরের শ্রমিকদের একটি অংশ হান্নান সাহেবের কাছে খুবই সাংগঠনিকভাবে সংযুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর যাকে আমরা এক দফা আন্দোলনের প্রবক্তা হিবেনে মনে করি, এম এ আজিজ সাহেব আমার খুব নিকট প্রতিবেশী হবার সুবাদে এবং আমাকে আত্মীয় হিসেবে খুবই পছন্দ করার কারণে আমি ছাত্র রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়ে পড়ি। সেই সব কথা আমি এখন বলতে চাই না ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭২ সাল থেকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আমার কি সংশ্লিষ্টতা ছিল সেটা এখন আমি আর বলতে চাই না। কিন্তু এম রেজাউল করিম বর্তমান চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন মেয়র তিনি একজন খুবই পরিশীলিত রাজনীতিবিদ এবং আমার চাইতে বয়সে ছোট হলেও তখন থেকে তাকে আমি ছাত্র রাজনীতিতে দেখেছি এবং তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আমার খুবই পছন্দ এবং শ্রদ্ধা ছিল। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে সর্বশেষ তিনি ষাটের দশকের ছাত্র নেতাদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেই সম্মেলনে স্মরণীয় বিষয় হলো সাবেক মেয়র এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঐ অনুষ্ঠানে বসে ছিলেন এবং আমাকেও তিনি বসিয়ে রেখে ছিলেন এবং ষাটের দশকের ছাত্র নেতা হিসেবে রেজাউল করিম আমাকে সম্মানিত করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে আমাদের প্রয়াত বন্ধু তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইউসুফ অনেক সময় ধরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং ষাটের দশকের প্রায় সকল ছাত্র নেতাকে সেখানে দেখা গিয়েছিল। আমি মনে করি রেজাউল করিম চৌধুরীর এই ষাটের দশকের ছাত্র নেতাদেরকে একত্রিত করার কাজটি খুবই উল্লেখযোগ্যভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং আমাকে উনি সেই সম্মেলনে সম্মানিত করেছিলেন আমি এটা কখনোই ভুলবো না।
চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় দক্ষতা এবং আন্তরিকতার সাথে কাজ করার জন্য আমি সাবেক মেয়র এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে এই সুযোগে স্মরণ করছি এবং আমাদের এলাকার একজন নেতা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ–সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন স্বল্প সময়ের জন্য সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী একজন নেতা সিটি কর্পোরেশন পরিচালনা করেছেন এবং সুনাম অর্জন করেছেন সেজন্য আমি তাকেও আজকে স্মরণ করছি। আমি আগেও বলেছি যে আমার কোনো সম্মাননা বা পদকের ব্যাপারে আগ্রহ নাই, আমার জীবনে অসংখ্য সম্মাননা পদক এবং ক্রেস্ট পাওয়ার ঘটনা আছে। আমি সেই সব বিষয়ে আগ্রহী নই। মানুষকে সম্মান দেওয়ার মালিক আল্লাহ, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সম্মানিত করেন। এই বিশ্বাস থেকে আমি কোনো মানুষের কাছ থেকে অথবা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা করি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তার এক বক্তৃতায় বলেছেন দেশের জন্য যারা নীরবে কাজ করে, সম্মাননা প্রদানের জন্য তাদের খুঁজে বের করতে হবে। যদি রাষ্ট্র এই নীতিতে কাজ করে তাহলে আমি মনে করি এটি দেশের জন্য একটি খুবই ভালো কাজ হবে।
আজ আমরা যারা ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে কঠিন দিনগুলিতে আমাদের জীবন বাজি রেখে কাজ করেছি তাদের কাছে অনেক প্রশ্ন আছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমাদের প্রজন্মের মানুষের সামনে একটাই প্রশ্ন ছিল আমরা কিছু একটা খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না, আমরা যা খুঁজছি সেটাই হলো স্বাধীনতা। আমাদের সকল কর্মকাণ্ডে আমরা স্বাধীনতাকে খুঁজতে খুঁজতে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে আমরা বিভোর ছিলাম। ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গঠিত হয়, সেখানে খুব সীমিত স্বপ্নচারী মানুষ তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, কলেজের ছাত্র তারা কল্পনা করতো বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে, তারাই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখত। এই নিউক্লিয়াসের পিছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণা দান ছিল মস্ত বড় একটি ফ্যাক্টর।
আমরা স্বাধীনতাকে স্বপ্ন দেখেছি এবং তাকে আমরা খুঁজে পেয়েছি তাহলে আজ আমাদের কোনো স্বপ্ন থাকার কথা নয়। আমাদের আর কোনো কিছুকে খোঁজার কোনো কথা নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে দেখতে পাই তিনি বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
আমরা স্বাধীনতা চাই অর্থনৈতিক মুক্তিও চাই। আমার মনে হয় যে এই কামনা কোনো বাহুল্য নয়। দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থবহ হবে এই ভাবনাটা সঠিক নয়। আমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলতে চাই ব্রিটিশ আমলে সারা পৃথিবীতে চট্টগ্রামকে বিউটি কুইন অব দ্য ইস্ট, প্রাচ্যের সৌন্দর্য রানী বলা হতো । চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের এমনকি এই উপমহাদেশের অনেক জায়গা প্রবেশের স্বর্ণধার বা গোল্ডেন গেট বলা হয়। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবল ভূমিকা রেখেছে এমনকি চট্টগ্রামের যেই বেতার কেন্দ্রকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সেটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন ১৯৬৬ সালে, চট্টগ্রাম থেকে সূর্যসেন বৃটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, চট্টগ্রামের মানুষ পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন। চট্টগ্রাম একটি ঐতিহ্যবাহী সুন্দর শহর, চট্টগ্রামবাসীর বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি অনেক অবদান আছে, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, এম এ হান্নানসহ সকল নেতা যারা স্বাধীনতার যুদ্ধের প্রাক্কালে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকে স্মরণ করে এবং চট্টগ্রাম থেকে গুণী মানুষদের সম্মাননা প্রদানের ক্ষেত্রে আরো জোরদার ভূমিকা তৈরি করা হবে, সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে এমন প্রত্যাশা রেখে আমি আমার লিখাটা এখানে শেষ করছি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ।