বর্ষা এলে বাড়ে আতংক

চট্টগ্রামে ২৬ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৪ মে, ২০২৫ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বর্ষা আসন্ন। প্রতি বছরই এ মৌসুমে চট্টগ্রামে ছোটবড় পাহাড় ধস, দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটে। তাই বর্ষা এলে চট্টগ্রামে স্থানীয় বসবাসকারী এবং নানান শ্রেণীপেশার মানুষের পাহাড় ধস নিয়ে উদ্বেগউৎকণ্ঠা বাড়ে। প্রতি বছর নগরীতে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ কার্যক্রম চলমান থাকলেও কিন্তু বসবাস বন্ধ হয় না। পাহাড়ে বসবাস করা বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন আয়ের। সেখানে বসবাসের জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ফলে বৃষ্টি হলেই মাটি ধসে দুর্ঘটনা ঘটছে। এরপর কিছু সময়ের জন্য প্রশাসনের তৎপরতা চোখে পড়ে। সময় যত গড়ায় তৎপরতাও থেমে যায়।

সরকারিবেসরকারি পাহাড়ের সংখ্যা : চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হালনাগাদ তালিকা অনুসারে নগরীতে সরকারিবেসরকারি ২৬টি পাহাড়ে এখন অবৈধ স্থাপনার সংখ্যা ৬ হাজার ৫৫৮টি। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের মালিকানাধীন ১৬টি পাহাড়ে বসবাস করছে ছয় হাজার ১৭৫টি পরিবার। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০টি পাহাড়ে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ৩৮৩টি। নগরীর বায়েজিদ লিংক রোড ও সলিমপুর, আকবর শাহ, অক্সিজেন, রৌফাবাদ, লালখান বাজার মতিঝর্ণা, ফয়’স লেক এলাকায় অবৈধ বসতি রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীতে সবচেয়ে বেশি অবৈধ পরিবারের বসবাস ফয়’স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল পাহাড়ে। এখানে মোট চার হাজার ৪৭৬টি পরিবার থাকে। ওই পাহাড়ের মালিকও বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটিসহ বাংলাদেশ রেলওয়ের মালিকানাধীন সাতটি পাহাড়ে অবৈধ বসতি আছে। এর মধ্যে মতিঝর্না ও বাটালি হিল এলাকায় বসবাস ৪৩১টি পরিবারের। লেকসিটি আবাসিক এলাকাসংলগ্ন বিজয়নগর পাহাড়ে বসবাস ২৮৮টি পরিবারের।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুধুমাত্র নগরীর মতিঝর্ণা, টাংকির পাহাড়বাটালি হিলটাইগারপাস হয়ে এসব এলাকায় ২০ থেকে ৩০ হাজারের বেশি লোক বসবাস করে।

গতকাল সরেজমিনে মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড়ে গিয়ে দেখা গেছে, অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ঘেঁষে বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। আবার অনেকগুলো পাহাড়ের উঁচুঢালু জায়গায় চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ৪৫ তলা বিল্ডিং পর্যন্ত উঠে গেছে। একেকটি বিল্ডিংয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে ১০ থেকে ১৫ পরিবার বসবাস করছে। অনেকগুলো বিল্ডিংয়ের উপরে টিনের ছাউনি দিয়েও বাসা তৈরি করে ভাড়া দেয়া হয়েছে।

পরিবেশ আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর এসব পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন এরা। এছাড়াও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করাসহ সমন্বিত উদ্যোগ না থাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের একেবারে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে বলে জানান পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা।

গতকাল মতিঝর্ণার পাহাড়ি এলাকায় বস্তিতে বসবাসকারী ভাসমান চায়ের দোকানদার রফিকুল ইসলাম ও ভ্যানে ভাসমান সবজি ব্যবসায়ী মহব্বত আলী ও রিকশা চালক নূর মিয়াসহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারী একাধিক বাসিন্দা জানান, তারা ভূমিহীন; এই শহরে কোথাও তাদের থাকার জায়গা নেই। ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও এখানে কম টাকা ভাড়ায় পরিবার নিয়ে থাকতে পারছেন বলে জানান। মহব্বত আলী জানান, বর্ষার কয়েক মাস আতংকে থাকতে হয়। অনেক সময় সারারাত জেগে থাকেন বলে জানান তিনি।

ভাসমান চা বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, তাদের যাওয়ার মতো স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। আর নগরীর সাধারণ বাসা ভাড়ার তুলনায় এখানে বাসা ভাড়া অনেক কম। তাই বাধ্য হয়ে জেনেশুনেই তারা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে এসব বাসায় ভাড়ায় থাকেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসন বিভিন্ন সময় তাদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি কখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

খবর নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ের মালিক সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতার সুযোগে এক শ্রেণির অসাধু মহল পাহাড়গুলো দখল করে সেখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে খেটে খাওয়া মানুষের কাছে ভাড়া দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভূসম্পত্তি বিভাগ থেকে জানা গেছে,

লালখান বাজার মতির্ঝণা পাহাড়টি মোট ২৬ একর। এরমধ্যে রেলওয়ের ১৮ একর। অবশিষ্ট ৮ একর সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ বিভাগের। কিছু অংশ জেলা প্রশাসনের ১ নং খাস খতিয়ান ভুক্ত।

গত ১৭ বছরে পাহাড় ধসে নিহতের সংখ্যা: পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৭ সালের ১১ জুন পাহাড়ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু পরই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ও অবৈধ বসতির তালিকা করা হয়েছে। সব মিলে ২০০৭ সাল থেকে গত ১৭ বছরে নগরে ও আশপাশে পাহাড়ধসে ২৫১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ ২০২৩ সালের আগস্টে নগরের পাঁচলাইশ থানাধীন ষোলশহর আইডব্লিউ কলোনিতে পাহাড়ধসে বাবা সোহেল (৩৫) ও তার সাত মাস বয়সী মেয়ে বিবি জান্নাতের মৃত্যু হয়। একই বছরের এপ্রিল মাসে আকবর শাহ এলাকায় মুজিবুর রহমান খোকা নামে একজনের মৃত্যুর হয় পাহাড়ধসে। এ ঘটনায় আরও তিনজন আহত হয়েছিলেন।

২০২২ সালে ১৭ জুন পাহাড়ধসে নিহত হন আরও চারজন। ওই দিন রাত দুইটায় এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিল ও ফয়’স লেক সিটি আবাসিক এলাকায় এ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও পাঁচজন আহত হন।

২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরের লালখানবাজার মতিঝর্না এলাকায় পাহাড়ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝর্নায় দেয়াল ধসে দুজন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান তিনজন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মারা যান মামেয়ে।

২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ফিরোজ শাহ কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড়ধসে এক শিশু প্রাণ হারায়।

লালখান বাজার এলাকার স্থানীয়দের দাবিনগরীর মতিঝর্ণা, টাংকির পাহাড়বাটালি হিলটাইগারপাস হয়ে এসব এলাকায় ২০ থেকে ৩০ হাজারের বেশি লোক বসবাস করে। এখানে ১৫ হাজারের মতো ভোটার আছে বলে জানান স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতা। শুধুমাত্র মতিঝর্ণা এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে এমন আড়াইশ পরিবার রয়েছে। এসব পাহাড়ে যারা বসবাস করছে তারা নিজেরানিজেরাই ঝুঁকি তৈরি করছে। তারা বর্ষা এলে পাহাড় কেটে দেয়, যাতে মাটি নিচে পড়ে তার বসবাসের এলাকাটি খোলামেলাবড় হয়ে যায়।

বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা আজাদীকে বলেন, এখানে যারা বসবাস করছেঅনেকেই বিল্ডিং করেছে, আসলে তাদেরকে এভাবে উচ্ছেদ করা যাবে না। পাহাড়ে বসবাসকারীদের অনেকেই ভূমিহীনঅসহায়। এরা যাবে কোথায়? পাহাড়গুলোর চারিদিকে যদি রিটেনিং ওয়াল করে দেয়া যায় তাহলে পাহাড়গুলো রক্ষা পেত। রিটেনিং ওয়াল দিয়ে পাহাড়গুলো সংরক্ষণ করা গেলে দখলমুক্ত করা সম্ভব হতো বলে বলে জানান পরিবেশবিদরা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্ধ থাকা সড়ক আলোকায়ন প্রকল্প চালু করতে চায় চসিক
পরবর্তী নিবন্ধআলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতামূলক সমাধানে আসুন : এবি পার্টি