বর্ষা আসন্ন, তাই খাল ও ড্রেন পরিষ্কারে অগ্রাধিকার

বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে মেয়র সিডিএর কাজ করা খালে ৩০ এপ্রিলের পর বাঁধ থাকলে সরিয়ে দেবে অভিযোগ ও পরামর্শ নিতে চালু হবে ‘আমাদের চট্টগ্রাম’ অ্যাপ

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২৫ at ৪:৪৪ পূর্বাহ্ণ

বর্ষাকাল আসন্ন হওয়ায় বর্তমানে খাল সংস্কারের মতো সময়সাপেক্ষ কাজ নয়, বরং জরুরি ভিত্তিতে খাল ও ড্রেন পরিষ্কারের কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, আমরা এখন প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছি বর্ষাকালের জলাবদ্ধতা মোকাবিলা। এজন্য খাল পরিষ্কার ও ড্রেন ব্যবস্থাপনার কাজ জোরদার করা হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার নগরের বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব কথা বলেন মেয়র। টাইগারপাস নগর ভবনে অনুষ্ঠিত ‘ক্লোজ ডোর’ বৈঠক শেষে বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন তিনি। এ সময় নগরের হিজরা খালে পড়ে ছয় মাসের শিশু শেহরিজের মৃত্যুর ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি তুলে ধরেন।

সভায় ডা. শাহাদাত সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের বলেন, সবগুলো সেবা সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু যেকোনোভাবে যখন একটি মৃত্যু হয়, তখন আপনি কী করেছেন মানুষ আর চিন্তা করে না। মানুষ তখন বলে সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএ বা ওয়াসা বা পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা পুলিশ কমিশনারের কারণে মৃত্যুটা হয়েছে। তাই আমাদের এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে, কীভাবে আমরা অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা থেকে শহরটাকে নিরাপদ রাখতে পারব।

তিনি বলেন, হিজরা খালে কাজ করছে সিডিএ। আমরা সিটি কর্পোরেশন কোনো কাজ করিনি। আমরা বাঁশ দিয়ে সেখানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা করেছিলাম, যাতে কেউ পড়ে না যায়। ওইদিন ঘটনার পর মেজর মাসুদ সেখানে গিয়েছিলেন, ঘণ্টাখানেক ছিলেন। উনার ভাষ্য অনুযায়ী উনারা তিনচারদিন আগে এটা পরিষ্কার করেছেন। খনন করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে বাঁশের যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল সেটা তারা তুলে ফেলেছেন।

মেয়র বলেন, কাজ করার পর আধ ঘণ্টাদুই ঘণ্টার মধ্যে ওটা (বাঁশের বেষ্টনী) আমরা লাগিয়ে দিতে পারতাম। ওটা থাকলে হয়তো আজ দুর্ঘটনা ঘটত না। সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে আমারও দায়িত্ব ছিল। আমার কোনো প্রকৌশলী বা পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা সেটা দেখেনি কেন? সিডিএ যে ৩৬টা খালে কাজ করছে সেখানে কোথায় কোথায় অরক্ষিত আছে? আমাদের এখন বর্ষাকালকে টার্গেট করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের ধরে নিত হবে বৈশাখ এসেছে মানে বর্ষাকাল চলে এসেছে। আগের মতো আষাঢ়শ্রাবণ ধরে থাকলে মনে হয় আমরা ভুল করছি। তাই কোথাও অরক্ষিত থাকলে আগামী ১৫২০ দিনের মধ্যে করে ফেলতে হবে। অন্যথায় একটি মৃত্যু হলে গত পাঁচছয় মাসে আমরা ভালো কাজগুলো করেছি তা জলাঞ্জলি দেবে।

পরে প্রেস ব্রিফিংয়ে মেয়র নালায় পড়ে শিশু মৃত্যুর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, দায়িত্ববোধের জায়গায় আমাদের আরো বেশি কমিটেড হতে হবে। যে দুর্ঘটনা হয়েছে সেজন্য সব সংস্থার পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা মনে করি এজন্য আমাদের সবার দায় রয়েছে। সিডিএ যে খালগুলোতে কাজ করছে সেখানে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কাজ করবে। এরপর খালে কোনো বাঁধ থাকলে সরিয়ে দেবে। সেখানে কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দরকার হলে প্রয়োজনে টেম্পোরারি হিসেবে বাঁশের বেড়া হলেও দেবে। আমাদের যেখানে যেখানে আছে সেখানে আমরা দিব। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়, এই অঙ্গীকারে আমরা সবাই মিলে একটি নিরাপদ ও সবুজ শহর গড়তে একযোগে কাজ করব।

মেয়র বলেন, নগরের নালা ও খালগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও ম্যানহোলের ঢাকনা নেই, কোথাও স্ল্যাব মিসিং। এসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করতে হবে। কর্পোরেশনের ছয়টি জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী ও আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় এই সমস্যাগুলো রয়েছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেড, বন্দর কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও কিছু জায়গা সরাসরি কোনো সংস্থার আওতায় পড়ে না, তবুও নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেগুলোতে কাজ করতে হবে। যেমন আগ্রাবাদের বঙ কালভার্টে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অনুরোধ করেছি কাজ করার জন্য।

একই সঙ্গে মেয়র ফায়ার সার্ভিস ও সিএমপির কার্যক্রমের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সিএমপি যেভাবে অবৈধ অটোরিকশা জব্দ করেছে, তা প্রশংসনীয়। এই অটোরিকশাগুলোই অনেক দুর্ঘটনার কারণ। ফায়ার সার্ভিসও সম্প্রতি দুর্ঘটনাস্থলে দ্রুত উপস্থিত হয়ে উদ্ধার তৎপরতায় ভূমিকা রেখেছে।

মেয়র বলেন, শপথ গ্রহণের পর গত ছয় মাসে নগরীর সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছি। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, ইনশাআল্লাহ সম্মিলিতভাবে কাজ করে জলাবদ্ধতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব এবং চট্টগ্রামবাসীকে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম হব। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চসিক, সিডিএ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, নেভি ও সেনাবাহিনীসহ সব সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে। বিশেষ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের সীমানার বাইরেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

তিনি বলেন, নগরবাসীর অভিযোগ ও পরামর্শ সহজেই গ্রহণের জন্য ‘আমাদের চট্টগ্রাম’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ অ্যাপে যে কেউ নালানর্দমা, ম্যানহোল ঢাকনা, ডাস্টবিন বা খালের সমস্যা সংক্রান্ত ছবি আপলোড করে সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে আমরা নাগরিক সেবাকে আরও কার্যকর ও জনবান্ধব করে তুলতে চাই।

নগরে পাহাড় কাটা প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, আমরা জিরো টলারেন্স নীতিতে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। ইতোমধ্যে পাহাড় কাটা বন্ধে অভিযান শুরু হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বর্ষার আগে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করতে হবে।

নগরবাসীর সচেতনতাকে জলাবদ্ধতা মোকাবিলার অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি ও নালায় পলিথিন ফেলা নগর ব্যবস্থাপনার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে নাগরিকদের সচেতন থাকতে হবে। শহরকে নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা আমাদের শহর, আমাদের দায়িত্ব। চট্টগ্রামকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও জলাবদ্ধতামুক্ত রাখার এই যাত্রায় সকল নাগরিককে পাশে চাই।

ডা. শাহাদাত বলেন, নগরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে পাওয়ার চায়নার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্ভাব্য অংশীদারত্ব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠান ২১টি খাল পুনঃখনন ও সংস্কারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে যে, সিটি কর্পোরেশন অনুমোদন দিলে এবং অর্থায়ন নিশ্চিত করা হলে তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে সরাসরি খাল সংস্কারের কাজ শুরু করতে প্রস্তুত।

তিনি বলেন, ময়লাকে সম্পদে রূপান্তরের জন্যও একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সলিড ওয়েস্ট থেকে বায়োগ্যাস, সার বা জ্বালানিতে রূপান্তরের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে নেদারল্যান্ডস, জাপান, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমরা সব দিক বিবেচনা করে এমন প্রতিষ্ঠান বেছে নিচ্ছি যারা দ্রুত কাজ বাস্তবায়নে সক্ষম। সময় দিলে আমরা একটার পর একটা সমস্যা সমাধানে সক্ষম হব।

ভূমিকম্পে দুর্ঘটনা এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে আমরা কর্পোরেশনে পাঠাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে লবণ মাঠ দখল নিয়ে দুইপক্ষের গোলাগুলি
পরবর্তী নিবন্ধপুলিশ দেখে পালানোর চেষ্টা, অস্ত্র-গুলিসহ যুবক গ্রেপ্তার