এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষার্থীরা কিচেন বর্জ্য থেকে তৈরি করছেন মাছ-মুরগির খাদ্য ও জৈব সার। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডাব্লিউ) বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত একটি স্বাধীন লিবারেল আর্টস ও বিজ্ঞান ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ ১৯টি দেশের মেয়ে শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। আমি এইউডাব্লিউতেও ২০১২ সাল থেকে মাঝে মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কিত কিছু কোর্সে পাঠদান করে আসছি। গত কয়েক মাস আগে এইউডাব্লিউ এর প্রতিষ্ঠাতা মহোদয়ের সাথে তাদের কিচেন এবং ডাইনিং হলের পচনশীল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠানে দৈনিক ৬০০ থেকে ৮০০ কেজি বর্জ্য উৎপাদন হয়। আমার দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে ব্লাক সোলজার ফ্লাই (Hermetia illucens) এর কথা উল্লেখ করি।
তিনি ব্লাক সোলজার (বিএসএফ) ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপর শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ এবং ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অংশ হিসেবে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের জন্য বায়েজিদ লিংক রোডের উপরে উক্ত প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী ক্যাম্পাসে মান-সম্মত একটি অবকাঠামো নির্মাণ করেন।
আমার তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যে এইউডাব্লিউ এর গবেষক দল ‘বিএসএফ’ ব্যবহার করে তাদের প্রতিদিনের বর্জ্য থেকে প্রায় ৭০/৮০ কেজি লার্ভা এবং সমপরিমাণ জৈব সার উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছেন। তারা তাদের উৎপাদিত বর্জ্য আবর্জনাকে ত্রিমুখী সম্পদে যেমন জৈব সার, হাঁস-মুরগি, পশু-পাখি ও মৎস্য খাদ্যের উৎস হিসেবে পেয়েছেন। এই পোকার জীবন চক্র মাত্র ৪৫ দিন, এরা পরিবেশবান্ধব, কোনো রোগজীবাণু বহন করে না, মানুষের বাসস্থান বা খবরের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। এই পোকার বেবী লার্ভা বর্জ্য আবর্জনাকে ১২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে জৈব সারে পরিণত করে এবং উক্ত সময়ের মধ্যেই বেবি লার্ভাগুলো বর্জ্য খেয়ে প্রায় ৬০০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে পূর্ণাঙ্গ লার্ভায় পরিণত হয়, যা হাঁস-মুরগি, পশু-পাখি ও মৎসের বিকল্প খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এ পোকার ভূমিকা প্রশংসনীয়। এরা বর্জ্যসমূহকে পচনের আগেই নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা রাখে, ফলে বর্জ্যের কারণে দুর্গন্ধ ছড়ায় না এবং গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনে। এই পোকার লার্ভাগুলো জীবন্ত এবং শুকনা উভয় অবস্থায় হাঁস-মুরগি, মাছ, পশু-পাখিকে খাওয়ানো যায়। এই পোকার লার্ভাতে প্রোটিনের মাত্রা প্রায় ৪৫ থেকে ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত থাকে যা আমাদের বাজারগুলোতে মাছ ও পোল্ট্রি খাবারে প্রোটিনের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
বিভিন্ন তথ্যমতে, এই পোকার শুকনা প্রতি কেজি লার্ভা থেকে প্রায় ২৪০ গ্রাম তেল আহরণ করা সম্ভব যা পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত আমদানিকৃত সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে।
এই পোকার উৎপাদন খরচ খুবই কম এবং তার বাজার মূল্য কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৫০ টাকা এবং উৎপাদিত জৈব সারের মূল্য ১০ থেকে ১৫ টাকা। এইউডব্লিউ এর শিক্ষার্থীদের এই প্রকল্প থেকে ‘বিএসএফ’ লার্ভা’ (হাঁস মুরগির খাবার) ও জৈব সার ব্যবহার করে তাদের গবেষণাকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। তাছাড়া বর্জ্য আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নেও আমাদের এই গবেষক দল ভূমিকা রাখতে পারবে।
এই পোকা সকল প্রকার হাঁস মুরগির পছন্দনীয় খাবার যা বাজারের পোল্ট্রি ফিডের তুলনায় সস্তা। এ কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও এই পোকার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
অন্যদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য বলছে ২০৩০ সাল নাগাদ ব্লাক সোলজার ফ্লাই এর বৈশ্বিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩৪ শতাংশের বেশি হবে। উল্লেখ্য যে, ২০২৪ সালে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই এর বাজার ছিল ৪.০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩৪ সালে দাঁড়াবে ২০.১২ মার্কিন ডলারে।
ব্লাক সোলজার ফ্লাই মার্কেটের বৃদ্ধি মূলত বিশ্বব্যাপী মাংস, মৎস ও সয়ামিল এবং ফিস মিলের দাম বৃদ্ধিই মূল কারণ। বিএসএফকে বিকল্প প্রোটিনের উৎস হিসাবে মৎস ও গবাদি পশুর খাদ্য সরবরাহার জন্য অনেকগুলো স্বনামধন্য কোম্পানির আমেরিকা কানাডা, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইউরোপ, পর্তুগাল, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত চীন, ডেনমার্কসহ আরো অনেক দেশে বাজার রয়েছে।
বর্তমানে আমাদের মাছ ও পোল্ট্রি ফিডের বাজার প্রায় ৯৮৬ কোটি টাকার উপরে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে দেশে হাঁস- মুরগি ও মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে আমদানিকৃত খাবারের উপর। উক্ত সমস্যার সমাধানে শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘বিএসএফ’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি প্রতিদিন ৭৪০ গ্রাম বর্জ্য উৎপাদন করে। সে হিসেবে ৭০ লাখ লোকের চট্টগ্রাম নগরে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদন হয় ৫ হাজার ১৮০ টন। উক্ত বর্জ্যের ৫০ শতাংশই পচনশীল। সিটি কর্পোরেশন মোট বর্জ্যের মাত্র ৪৮ শতাংশ সংগ্রহ করতে পারে। বাকি বর্জ্য রাস্তাঘাট, নালা- নর্দমা, খাল, পুকুর ও নদীতে আশ্রয় নেয় এবং জলবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বিএসএফ ব্যবহারের ফিলিপাইনের আদলে মাধ্যমে উক্ত পচনশীল বর্জ্য থেকে দৈনিক কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৫০০ টন বিএসএফ লার্ভা ও সমপরিমাণ জৈব সার উৎপাদন সম্ভব, যার বাজার মূল্য (২০ টাকা কেজি হিসেবে) দাঁড়াবে ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। উৎপাদন খরচ বাদে দৈনিক আয় দাঁড়াবে ১ কোটি টাকা। হিসাব মতে শুধু চট্টগ্রাম শহরের ৭০ লক্ষ লোকের উৎপাদিত পচনশীল বর্জ্য আবর্জনা থেকে বছরে প্রায় ৩৬৫ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
উক্ত কাজটি করার জন্য শহরে বসবাসকারী অধিবাসীগণ এবং পোল্ট্রি ফিড কোম্পানিগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো পচনশীল বর্জ্যগুলোকে নির্দিষ্ট পাত্রে ও নির্দিষ্ট সময়ে সংগ্রহের জন্য সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীদেরকে সহায়তা করতে হবে। পরিচ্ছন্ন কর্মীগণ তাইওয়ানের মত মিউজিক বাজিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করবেন। এই প্রক্রিয়ায় অতি সহজে আমাদের সিটিকে ক্লিন সিটি, গ্রীন সিটি ও হেলদি সিটিতে পরিণত করা সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় মেয়র মহোদয় পরীক্ষামূলকভাবে যে কোনো একটি ওয়ার্ড থেকে পচনশীল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ কাজটি শুরু করতে পারেন, তার জন্য সব রকমের পরামর্শ ও সহযোগিতা আমাদের থাকবে।
লেখক: অধ্যাপক, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন-এর গবেষক দলের পরামর্শক।