জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান চট্টগ্রাম বন্দর–কাস্টমসের কর্মকর্তা ও সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর এটি তার প্রথম সফর। গতকাল বুধবার সকালে বন্দর ভবনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা চিঠিপত্র চালাচালির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে চাই। এজন্য পানগাঁওসহ বিভিন্ন অফডকে ৩৮টির বেশি পণ্য রাখার প্রয়োজন। বন্দরে পড়ে থাকা কন্টেনারের পণ্য দ্রুততার সঙ্গে নিলাম প্রক্রিয়া যাওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে বিস্ফোরক পণ্য যেগুলো বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে সেগুলো ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করা প্রয়োজন। সভায় বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি নিয়ে পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন চবকের পরিবহন বিভাগের পরিচালক এনামুল করিম। প্রেজেন্টেশনে তিনি পানগাঁওয়ে স্ক্যানার বসানোসহ কাস্টমসের সঙ্গে অনলাইন কানেক্টিভিটি বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। এছাড়া নিলামে বিক্রি করা পণ্যের বিপরীতে বকেয়া ১৪১ কোটি ২১ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ টাকা ধাপে ধাপে পরিশোধ করার কথা বলা হয়।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের সার্ভারের সংকট নিরসন ও পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনে এনবিআর জোর দিচ্ছে। এই সিস্টেমে জালিয়াতি ও কারসাজির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির অপচেষ্টা রোধ ও জালিয়াত চক্র চিহ্নিত করতে এনবিআর কাজ করছে। কোনো হয়রানি ছাড়া ব্যবসায়ীদের দ্রুত ও হয়রানিমুক্ত সিমলেস সেবা নিশ্চিতে কর্মকর্তাদের দক্ষতাও বাড়াতে হবে।
আলোচনায় বন্দরের স্ক্যানার সংকট নিরসনে নতুন ৫টি স্ক্যানার দ্রুত স্থাপনের পাশাপাশি বন্দরের কনটেইনার জট নিরসনে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কাজ করছে বলে জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। অপরদিকে বিকেলে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। মতবিনিময়কালে সংগঠনটি ১৪টি দাবি উপস্থাপন করে। গতকাল বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু তাদের দাবি উপস্থাপন করেন। দাবিগুলো হলো– অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম মন্থরগতিতে কাজ করে। এর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে স্থায়ী সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় ব্যবহারকারীগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া পণ্যের শুল্ক মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা, ২০০০ যথাযথভাবে পরিপালন করা। এই বিধিমালার সাথে সাংঘর্ষিক ২০২২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে জারি করা এনিবআরের আদেশ বাতিল করা। একই সাইজের কন্টেনারে আনা একই জাতীয় পণ্যের ওজন নির্ণয়ে কাস্টম হাউস ও কাস্টমস স্টেশন ভেদে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হওয়া। অনিচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাবশত বা শুল্ক ফাঁকির উদ্দেশ্যে নয় এমন ক্ষেত্রে সিপিসি বা এইচএসকোড ভুল প্রদান করা হলে তা ন্যায় নির্ণায়ণ না করা। আমদানি পণ্যের ঘোষণাপত্র (বিল অব এন্ট্রি) ও আমদানি দলিলাদিতে পণ্যের বাণিজ্যিক বর্ণনা সঠিক ও সম্পূর্ণ থাকলে, সেক্ষেত্রে এইচএস কোড ভুল প্রদান করা হলে, মিথ্যা ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা না করা। কাস্টমস এজেন্টস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০২০ এর কতিপয় বিধি সংশোধন করা। যেমন– লাইসেন্সের মেয়াদ ৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর করা। লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করার পূর্বে কাস্টমস এজেন্টকে ১৫ কার্যদিবস সময় প্রদান করে কারণ দর্শাবার সুযোগ প্রদান করা। মূল লাইসেন্স বাতিল হলে রেফারেন্স লাইসেন্স বাতিল না করা। কাস্টমস আইন, ২০২৩ এর ধারা ৮২ (ঘ) এর শেষাংশে উল্লেখিত পণ্য ঘোষণায় প্রদত্ত তথ্যের সঠিকতা, সম্পূর্ণতা, উপস্থাপিত দলিলের সত্যতার জন্য কাস্টমস এজেন্টকে দায়ী করার বিধান রহিত করা। রিস্ক ম্যানেজমেন্টের আওতায় অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লককৃত এইচএস কোডসমূহের মধ্যে যে সকল এইচএস কোডের পণ্যচালানে দীর্ঘদিন ধরে কায়িক পরীক্ষায় অনিয়ম পাওয়া যায়নি বা অনিয়ম পাওয়া গেলেও তা খুবই নগণ্য, সে সকল এইচএস কোডসমূহ বাধ্যতামূলক কায়িক পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি প্রদান করা। একই আমদানিকারক কর্তৃক আমদানিকৃত একাধিক পণ্যচালান একই কন্টেনারের মাধ্যমে আনার ক্ষেত্রে কন্টেনারে পার্ট এফসিএল হিসেবে খালাসের অনুমতি প্রদান করা। আমদানিকারকের মনোনিত সিএন্ডএফ এজেন্টের নাম সিস্টেমে তালিকাভুক্তির অনুমতি দ্রুততম সময়ে প্রদান করা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করা, যাতে পণ্যের নমুনা পরীক্ষার জন্য বহিঃল্যাবে প্রেরণ করতে না হয়। চালানভুক্ত পণ্যের এমএসডিএস বা টিডিএস অনুযায়ী পণ্যের বিবরণ, প্রকৃতি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হলে তা রাসায়নিক পরীক্ষা না করা। এছাড়া সিএন্ডএফ কমিশনের উপর পরিশোধিত আয়করকে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে আয়কর আইনে সন্নিবেশিত করা। বেসরকারি আইসিডি/সিএফএস নীতিমালা–২০১৬ অনুযায়ী অফডক সমূহ পরিচালনা নিশ্চিত করা। বেসরকারি আইসিডি সমূহের স্বেচ্ছাচার বন্ধ করে ব্যবহারকারীদের যথাযথ সেবা প্রদান নিশ্চিত করা। দেশের রপ্তানি বাণিজ্য নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বেসরকারি আইসিডি সমূহে কর্মরত কাস্টমস কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা।
সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, আপনাদের সবগুলো দাবিই বিবেচনা করা হবে। যৌক্তিকভাবে আমরা সংস্কার করবো। এছাড়া পণ্যের এইচএস কোডের বিষয়ে পর্যালোচনা করা হবে। এটি নিয়ে আর যেন কোনো ভোগান্তি পোহাতে না হয়। আরেকটি বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসে ১৯৯৩ সাল থেকে অটোমেশন চালু হয়েছে। কিন্তু তা এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। আমি জানতে চাই, এটা কবে পূর্ণাঙ্গ হবে? সমস্ত কাজ অটোমেশনে করার জন্য যা প্রয়োজন করেন, এটির দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।
সার্ভারের জটিলতা সমাধানে তিনি বলেন, অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের সার্ভার প্রায় সময় স্লো থাকে। এটা বড় একটা সমস্যা। আমরা এ সমস্যার কারণে এক মিনিটও সময় নষ্ট হোক তা চাই না। আমরা এতোগুলো মানুষ যদি ফ্রিকুয়েন্টলি ফেসবুক চালাতে পারি, তবে অ্যাসাইকুডাতে কেন সমস্যা হবে। বিশ্বের সবদেশে অটোমেশন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সার্ভারের সমস্যা রোধে আমরা যতদ্রুত সম্ভব ক্লাউডে চলে যাবো। তিনি বলেন, আমাদের প্রফেশনাল হতে হবে। আমাদের আরো সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। আমরা যেহেতু ব্যবসায়ীদের সেবা প্রদান করি, তাদের প্রতি আমাদের সহমর্মী হতে পারি। আমরা দ্রুত তাদের সেবা দেব এবং সেই সেবাটা হবে কোনোরকমের কোনো হয়রানি ছাড়া।
পরবর্তীতে বিকেল ৫টায় কাস্টম হাউসের সম্মেলন কক্ষে এনবিআর চেয়ারম্যান পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ নেতাদের সাথে মতবিনিময় করেন। সভায় বিজিএমইএর প্রথম সহ–সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে গত জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে স্বাভাবিক উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের প্রবল চেষ্টা থাকা স্বত্ত্বেও অস্থিরতা এখনও বিরাজমান, বন্ধ রয়েছে অনেক পোশাক শিল্প কারখানা। অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে আগামী মৌসুমের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক শিল্পের বিশ্বে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে কাস্টমস প্রক্রিয়াগুলোকে আরো সহজীকরণ, দ্রুততম ও হয়রানিমুক্ত করার জন্য এনবিআরের সার্বিক সহায়তা আশা করেন। আমদানিকৃত কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি দ্রুত খালাসকরণসহ শুল্ক, ভ্যাট ও বন্ড সংক্রান্ত সমস্যার দ্রুত সমাধানের দাবি জানানো হয়। এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খাঁন বলেন, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও কর্মসংস্থানে পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বিজিএমইএর প্রতিনিধি দলকে পোশাক রপ্তানিকারকদের সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এনবিআরের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ’র সহ–সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক এম এহসানুল হক, মোহাম্মদ মুসা, আমজাদ হোসেন চৌধুরী, মোস্তফা সরওয়ার রিয়াদ, রাকিব আল নাসের, গাজী মো. শহীদউল্লাহ, সাবেক প্রথম সহ–সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, এসএম আবু তৈয়ব, নাসিরউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুস সালাম, সাবেক পরিচালক এ এম মাহাবুব চৌধুরী, অঞ্জন শেখর দাশ ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেন প্রমুখ।
পরবর্তীতে এনবিআর চেয়ারম্যান গতকাল বিকেল ৫টায় কাস্টম হাউসের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এঙেসরিজ এসোসিয়েশনের নেতাদের সাথে মতবিনিময় করেন। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, কোনো অনিয়ম দেখলেও আপনারা অভিযোগ করেন না। আর সেই কারণেই আমরাও অনেক অপরাধী অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। আপনারা যদি সঠিকভাবে ব্যবসা করেন তাহলে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। অনলাইনেই আপনাদের জন্য অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। সেখানে কোনো অভিযোগ জমা পড়লে সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে আমরা কি ব্যবস্থা নিয়েছি তা অভিযোগকারীকে জানাতে আমরা বাধ্য। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে অভিযোগ করুন। সকল অনিয়ম এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এঙেসরিজ এসোসিয়েশনের সভাপতি ও দি পূর্বকোণ লিমিটেডের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সংগঠনের অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সহ–সভাপতি জামিল আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল, সহ–সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন। পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ এনামুল হক, তৌফিকুল আলম, মোহাম্মদ আরিফ হোসেন ও সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জাসির চৌধুরী ও কেফায়েত উল্যাহ। এ সময় এনবিআরের বোর্ড সদস্যবৃন্দ, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কমিশনার মো. জাকির হোসেন এবং কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
সৌজন্য স্বাক্ষাতে চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এঙেসরিজ এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ এনবিআর চেয়ারম্যানকে গার্মেন্টস এঙেসরিজ ব্যবসা সংক্রান্ত চিহ্নত ১১টি দাবি উল্লেখ করেন। বিপরীতে দাবিগুলো আমলে নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান তাৎক্ষণিক সেখানে উপস্থিত এনবিআর বোর্ড সদস্যদের দাবিগুলো সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন।