বন্দরে কন্টেনার ও জাহাজ জট ক্রাশ প্রোগ্রাম নেয়ার আহ্বান

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৩ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনার জটের পাশাপাশি মারাত্মক রকমের জাহাজ জট শুরু হয়েছে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিদেশি পণ্য বোঝাই কন্টেনার জাহাজ অলস বসে থাকার ঘটনা ঘটছে। বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। বন্দরের ইয়ার্ডে আটকা পড়া কন্টেনারের সংখ্যাও অস্বাভাবিক। অপরদিকে আইসিডিগুলোতেও রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনারের পাহাড় তৈরি হয়েছে। যা স্বাভাবিকের প্রায় দ্বিগুন। অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যে মারাত্মক ধরনের সংকট তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গতকাল আমদানিকারকদের জানিয়েছে যে, অন্যান্য দিনের মতো শুক্র, শনি এবং রবিবারও সব ধরনের পণ্য বোঝাই কন্টেনার সরবরাহ দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

সূত্র জানিয়েছে, কোটা আন্দোলন ইস্যুতে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জুলাই মাসের শেষদিকে দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ, সাধারণ ছুটিতে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কারফিউতে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে থাকায় দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য বড় ধরনের ধাক্কা খায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে ছিল। কারখানা থেকে আইসিডি কিংবা আইসিডি থেকে বন্দরে পণ্য পরিবহনও নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোটায়। ওই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে নামানো কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠে। যা আইসিডি, কারখানা কিংবা আমদানিকারকদের নিকট সরবরাহ দেয়া সম্ভব হয়নি। টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকায় বন্দরে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বহু বেশি কন্টেনার আটকা পড়ে। রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় বন্দরে ঢাকা আইসিডিমুখি কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠে। পাঁচদিন পর সীমিত পরিসরে কার্যক্রম শুরু এবং মাত্র দিনকয়েক কাজ করার পর আবারো সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পুলিশিং কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। প্রশাসনও চলে ঢিমেতালে। এতে করে নিরাপত্তাসহ সার্বিক অবস্থায় পণ্য পরিবহন থমকে যায়। যার প্রভাব পড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে।

চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিকভাবে ৩০/৩১ হাজার টিইইউএস কন্টেনার থাকলে তা ৪৪ হাজারের বেশিতে গিয়ে ঠেকে। বাড়তি কন্টেনারের চাপ সামলাতে গিয়ে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম ব্যাহত হয় মারাত্মকভাবে। গত কয়েকদিনের চেষ্টা করেও কন্টেনারের সংখ্যা স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। গতকাল বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেনারের সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৯৪১ টিইইউএস। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। এতো বেশি কন্টেনার ইয়ার্ড দখল করে থাকায় বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। যার প্রভাবে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। কন্টেনার জটের পাশাপাশি বন্দরে দেখা দিয়েছে জাহাজ জট।

অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করা চট্টগ্রামের ১৯টি আইসিডিতে কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠেছে। সচরাচর আইসিডিগুলোতে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টিইইউএস পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার থাকে। গতকাল সেখানে ১৫ হাজার ১৪২ টিইইউএস কন্টেনার ছিল। আইসিডি থেকে বন্দরে কন্টেনার প্রেরণের কার্যক্রমে স্থবিরতা আসায় আইসিডিগুলোতে কন্টেনারের পাহাড় গড়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার সচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন সিকদার। তিনি বলেন, এটি খুবই অস্বাভাবিক। গত দুই বছরে কোনদিন এতো রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার ইয়ার্ডে আটকা পড়ার রেকর্ড নেই। বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতে আমাদের আইসিডিগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আমরা দ্রুত কন্টেনার জাহাজীকরণ করতে পারলে এমন সংকটে পড়তে হতো না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বন্দরের ইয়ার্ড থেকে আরো কিছু আমদানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার আইসিডিতে পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, অন্তত পাঁচ হাজার কন্টেনারও যদি সরিয়ে আনা যায় তাহলে বন্দরের ইয়ার্ডে জায়গা তৈরি হবে, যাতে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে সুবিধার পাশাপাশি জাহাজের অবস্থানকাল কমে আসবে। যা বন্দরকে জাহাজজট থেকেও মুক্ত করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বন্দরের কর্মকর্তারা বলেছেন, আমরা চাইলে কোন কন্টেনার আইসিডিতে পাঠাতে পারি না। ৩৮ ধরণের পণ্যবোঝাই আমদানিকৃত কন্টেনার আইসিডিতে পাঠানোর নিয়ম রয়েছে। এর বাইরের পণ্যগুলো পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি পাঠাতে হয় তাহলে সরকার থেকে বিশেষ অনুমোদন পেতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ড এবং আইসিডিগুলোতে দেখা দেয়া ভয়াবহ কন্টেনার জটের মাঝে বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজজট দেখা দিয়েছে। গতকাল বন্দরের বহির্নোঙরে ১৮টি কন্টেনার জাহাজ অলস বসে রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি জাহাজ গিয়ারলেস (যে জাহাজের নিজস্ব ক্রেন নেই। গ্যান্ট্রি ক্রেন ছাড়া কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে না।) এবং ৬টি গিয়ার ভ্যাসেল। এরমধ্যে গত ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছেছে এমন জাহাজও রয়েছে। একটি জাহাজ একদিন অলস বসে থাকলে অন্তত ১৫ হাজার ডলার এফওসি বা ফিঙড অপারেটিং কস্ট ব্যয় হয়। যা ঘুরে ফিরে দেশের সাধারণ ভোক্তাদের উপরই পড়ে।

চট্টগ্রাম বন্দরে দেখা দেয়া জাহাজ এবং কন্টেনার জট নিরসনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়ার জন্য আমদানি রপ্তানিকারকদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্যথায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বড় ধরণের সংকটে পড়বে বলেও তারা মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেছেন, বন্দরে পুরোদমে কাজ চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নতির জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৫ বছরে ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ : সিপিডি
পরবর্তী নিবন্ধবন্দরের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মনিরুজ্জামানের দায়িত্বভার গ্রহণ