বন্দরের আয়ের ভাগ আদায়ে চসিকের নতুন উদ্যোগ

সার্ভিস চার্জ হিসাবে ১ শতাংশ অর্থ পেতে আজ মেয়রের প্রস্তাব যাচ্ছে মন্ত্রণালয়ে, এবার সুফল মেলায় আশা

মোরশেদ তালুকদার | বৃহস্পতিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

নগরের রাস্তাঘাট সংস্কার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের আয়ের একটি অংশ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) দেয়া হোক; এমন দাবি ও আলোচনা আছে দীর্ঘদিন ধরে। এর প্রেক্ষিতে ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন’এর খসড়ায় বন্দরের আয়ের ১ শতাংশ অর্থ চসিককে দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তও করা হয়। যা আইনটি চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় বাদ দেয়া হয়। পরবর্তীতে অন্য কোনো উপায়ে এ অর্থ আদায় করা যায় কীনা সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সুফল মেলেনি। এ অবস্থায় বন্দর থেকে প্রত্যাশিত সেই অর্থ আদায়ে উদ্যোগ নিচ্ছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। বন্দরের বাৎসরিক আয় থেকে ১ শতাংশ হারে সার্ভিস সার্জ হিসেবে দাবি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পত্র দিচ্ছেন তিনি। মন্ত্রণালয়টির উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) . এম সাখাওয়াত হোসেন বরাবর আজ এ চিঠি পাঠানোর কথা রয়েছে। এর আগে বন্দর চেয়ারম্যান টাইগারপাস নগর ভবনে সাক্ষাতে এলেও মেয়র ‘নগর উন্নয়ন মাশুল’ হিসেবে অর্থ প্রদানের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

এদিকে অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ নগরবাসী মেয়রের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা চট্টগ্রামের বাসিন্দা। তাই এবার কর্পোরেশনের প্রস্তাব এবং দীর্ঘদিনের দাবিটি পূরণের বিষয়ে আশাবাদী তারা। বন্দরের আয় থেকে চসিককে বরাদ্দ দেয়া হলে রাস্তাঘাট সংস্কার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে গতি আসবে বলেও মনে করেন তারা। এছাড়া একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শহরের রাস্তাঘাটের বড় ব্যবহারকারী বন্দর। তাই রাস্তাঘাটের রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান চসিককে অর্থ দেয়াও উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কী থাকছে চসিকের প্রস্তাবে : চসিক সূত্রে জানা গেছে, আজ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে যে প্রস্তাব পাঠানো হবে সেখানে গতকাল সন্ধ্যায় স্বাক্ষর করেন মেয়র ডা. শাহাদাত। এতে সিটি কর্পোরেশনকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ১ শতাংশ হারে অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। এ অর্থ পেলে চসিকের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রধান সড়ক, কালভার্ট ও টেকসই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদনে চসিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।

সার্ভিস চার্জের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলা হয়, চট্টগ্রামের অধিকাংশ রাস্তা ৬১০ টন ওজনের গাড়ির জন্য নির্মাণ করা হলেও ৫০৬০ টনের বোঝা নিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। হাজার হাজার ট্রাক, লরিসহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করায় নগরের অভ্যন্তরীণ রাস্তাঘাট দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর, জেটি হতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সড়কে অসংখ্য ভারী যানবাহন চলাচল করে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী সড়কগুলো এ কারণেই প্রতিনিয়ত নষ্ট হয়। এসব ভারী যানবাহনের কারণে নিয়মিত রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে নগরবাসীর চলাচলে যানজটসহ চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। জনগণের চলাচলের জন্য সুষ্ঠু সড়ক ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম দায়িত্ব। এসব রাস্তাঘাট নিয়মিত সংস্কার করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন যা সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান সক্ষমতা দিয়ে যোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

উল্লেখ্য, গত ২০২৩২০২৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর কন্টেনার হ্যান্ডলিং করেছে ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউস। এছাড়া কার্গো বা খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ মেট্রিক টন। বন্দরের পণ্যভর্তি কন্টেনারের সিংহভাগ পরিবহন হয়েছে সড়ক পথে। অর্থাৎ বন্দরের পণ্যবাহী যানের চাপ বাড়ছে নগরের সড়কে। কী বলছেন মেয়র : সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, আমাদের যে ন্যায্যা হিস্যা সেটা বন্দর অবশ্যই দিবে বলে মনে করি। এটা সিটি কর্পোরেশনের পাওনা। তাই বন্দরের উচিত এ টাকা দিয়ে দেয়া। বন্দর তো সব জায়গায় টাকা দিচ্ছে, কর্পোরেশনের পাওনা কেন দেবে না।

তিনি বলেন, বন্দরের বড় বড় গাড়িগুলো কিন্তু আমাদের রাস্তা দিয়ে চলছে। আমরা তাদের আমাদের সমস্ত লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছি। বন্দরের ভারী গাড়িতে আমাদের সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সড়কগুলো মেরামত করতে কর্পোরেশনের রাজস্ব আয়ের বড় অংশ চলে যায়। বন্দরকে সচল রাখতে ভাল সড়ক নির্মাণে চসিকের অনেক অর্থের প্রয়োজন। বন্দর যদি আয়ের ১ শতাংশ চসিককে দেয় তাহলে চসিক অবকাঠামো খাতে আরো ভূমিকা রাখতে পারবে।

মেয়র বলেন, বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। উনিও সার্বিক সহযোগিতা দেবেন বলেছেন। কাজেই যে চিঠি দিচ্ছি তাতে সুফল পাব বলে আশা করছি।

মেয়র বলেন, কেবল চিঠি দিচ্ছি না। এ ব্যাপরে মন্ত্রণালয়ে দেনদরবার করব এবং এ ব্যাপারে তাদের বুঝানোর চেষ্টা করব, এটা সিটি কর্পোরেশনের পাওনা এবং সেটা যেন দিয়ে দেয়। এ অর্থ পেলে চট্টগ্রামকে আরো ভালোভাবে সাজাতে পারব। বন্দরও যদি চট্টগ্রামের উন্নয়ন চায়, তারা যদি তাদের মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি বলে তাহলে ১ শতাংশ অর্থ পেতে সমস্যা হবে না।

উল্লেখ্য, গত ১২ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান টাইগারপাস নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন মেয়রের সঙ্গে। এসময় চট্টগ্রাম বন্দরের আয়ের ১ শতাংশ ‘নগর উন্নয়ন মাশুল’ হিসেবে দেওয়া হলে শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সিটি কর্পোরেশন আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে বন্দর চেয়ারম্যানকে জানান ডা. শাহাদাত।

অতীতেও আলোচনায় ছিল বিষয়টি : ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ‘কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, দখল ও দূষণ রোধে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন, চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন সংক্রান্ত’ একটি আলোচনা সভা হয়। ওই সভায় ‘চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্বৃত্ত অংশ থেকে একটি ভাগ চসিককে কিভাবে দেয়া যায় কিংবা কী উপায়ে চসিক পেতে পারে তার উপায় খুঁজতে যৌথভাবে দুই সংস্থা আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও ওই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে কার্যকর হয়নি।

একই সভায় চসিকের প্রস্তাবনা ছিল, ‘স্বায়ত্বশাসিত, আধাস্বায়ত্বশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক ননফাইন্যান্সিয়াল কর্পোরেরশনসহ স্বশাসিত সংস্থাসমূহের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান আইন, ২০২০ এর ৫নং ধারার আংশিক সংশোধন করে বন্দরের আয়ের উদ্বৃত্ত টাকা চসিকের অনুকূলে যেন বরাদ্দ দেয়া হয়।’ এর প্রেক্ষিতে সভায় উপস্থিত বন্দরের তৎকালীন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল শেখ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সরকার দিলে আমাদের আপত্তি নেই।’

এর আগে ২০২১ সালের ২০ জুন বন্দর ভবনে অনুষ্ঠিত চসিক ও বন্দরের যৌথসভায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানিরপ্তানির প্রতিটি কনসাইনমেন্টের (চালান) বিপরীতে ‘সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ’ নামে কোনো ফি শুল্ক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদায় করা যায় কীনা তার উপায় খোঁজারও সিদ্ধান্ত হয়।

এছাড়া গত ১৫ মে চসিকের প্রাক বাজেট (২০২৪২৫ অর্থবছর) আলোচনায়ও বন্দর থেকে ‘সিটি ডেভেলপমেন্ট চার্জ’ আদায়ে একমত পোষণ করেন সুশীল সমাজ।

খসড়ায় থাকলেও চূড়ান্ত আইনে বাদ : ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন ২০২১ এর চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রিপরিষদের সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। ওই খসড়ায় এতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ শতাংশ অর্থ চসিককে প্রদানের বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত ছিল। নগরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য এ অর্থ প্রদান করার কথা ছিল। অথচ ২০২২ সালের এপ্রিলে ওই খসড়া ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন২০২২’ হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এতে চসিককে ১ শতাংশ অর্থ দেয়ার বিষয়টি বাদ পড়ে।

এবার আশাবাদী : অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির ভিসি মু সিকান্দর খান আজাদীকে বলেন, একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বন্দরের মত আর কেউ চট্টগ্রাম শহর ব্যবহার করছে না। চট্টগ্রাম শহর বলতে শহরের যে পরিষেবাগুলো আছে, বিশেষ করে রাস্তাঘাট। কাজেই এই শহরের রক্ষণাবেক্ষণে বন্দরের একটা অংশীদারিত্ব থাকা ভাল।

তিনি বলেন, রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, রাস্তায় আলোকায়ন, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমহ নাগরিক সেবাগুলো নিশ্চিতের দায়িত্ব কর্পোরেশনের। কর্পোরেশন যে সেবা দেয় তার একক ব্যবহারী হিসেবে বড় প্রতিষ্ঠান বন্দর। আবার বন্দর যে শুধু চট্টগ্রামবাসীর জন্য জিনিসপত্র আনানেয়া করে তা না। পুরো বাংলাদেশের জন্য আনানেয়া করছে। সুতরাং বন্দরের কিছু অংশীদারিত্ব অর্থায়নের মাধ্যমে এখানে থাকা উচিত। বন্দরের ভারী যানবাহনগুলো শহরের রাস্তাঘাটের উপর দিয়ে যাচ্ছে। সেই রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িতপালনকারী সিটি কর্পোরেশনকে কিছু অর্থ বন্দরের অবশ্যই দেয়া উচিত। বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা চট্টগ্রামের। তাই বন্দরের আয় থেকে কর্পোরেশনকে অর্থ বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে বলেও আশাবাদী এ অর্থনীতিবিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসশস্ত্র বাহিনী দিবস আজ
পরবর্তী নিবন্ধধ্বংস করা হল মাল্টাসহ নিলাম অযোগ্য ২১ কন্টেনার পণ্য