গ্যাস চুরি, গ্যাসের অপচয়, এক চুলায় অন্তত দশ পরিবারের রান্না, পাইপসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নগরীতে গ্যাসের এক লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। নগরীর এবং মফস্বলে এক চুলার অনুমোদন নিয়ে একাধিক চুলা জ্বালানো, কিংবা অনুমোদিত একটি চুলাতে সকাল থেকে রাত অব্দি অন্তত দশ পরিবারের রান্নার আয়োজন চলে বলে উল্লেখ করে সূত্র জানিয়েছে যে, প্রি–পেইড মিটারে এই সুযোগগুলো সীমিত হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকদের মিটার লাগানোতে চরম অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গতকাল সীতাকুণ্ডের সলিমপুরে একটি বাড়িতে একটি চুলা রয়েছে বলে জানানো হলেও পরে ঘরে ঢুকে দেখা যায় যে, বাড়িতে পাঁচটি চুলা জ্বলছে। কর্ণফুলী গ্যাসের টিম গিয়ে উক্ত বাড়ির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। গতবছরের জানুয়ারি মাস থেকে চট্টগ্রামে গ্যাসের এক লাখ প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হলেও নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত গত প্রায় চৌদ্দ মাসে ৬৮ হাজার ৮শ’ গ্রাহকের বাসায় প্রি–পেইড মিটার স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। গ্রাহকদের অনীহার মুখে আগামী জুনের মধ্যে বাকি ৩১ হাজার মিটার স্থাপন করার বিষয়টি উপোরক্ত কারণগুলোতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে আবাসিক খাতে গ্যাসের অপচয় এবং চুরির ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন কলোনি, বস্তি, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক বাড়িতে গ্যাস চুরির মহোৎসব চলে। চলে লাখ লাখ ঘনফুট গ্যাসের অপচয়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি, বন্দর কলোনি, ব্যাংক কলোনি, ইপিজেড এলাকার বড় বড় বস্তিগুলোতে গ্যাস চুরি এবং অপচয় মারাত্মক বলে মন্তব্য করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশিন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) একজন কর্মকর্তা বলেন, সরজমিনে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। রেলওয়ে কলোনির অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, একজন কর্মচারী যে বাসাটি বরাদ্দ পেয়েছেন তার সাথে যত খালি জায়গা রয়েছে সবগুলোতে তিনি ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। নিজের নামে বরাদ্দকৃত একটি চুলা থেকে ভাড়াটিয়াদের লাইন দেয়া হয়েছে। অনুমোদিত একটি চুলার সাথে পাঁচ সাতটি চুলা জ্বলছে। আবার অনেকেই নিজের অনুমোদিত চুলাটি ভাড়াটিয়াদের ব্যবহার করতে দেন। এতে করে সকাল থেকে রাত অব্দি চুলাটি জ্বলতে থাকে। একটি ডাবল বার্ণার চুলার ১ হাজার ৮০ টাকা বিল দিয়ে দশ পরিবার রান্না করছে এমন ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শুধু বস্তিতেই নয়, বিভিন্ন বাড়িতেও এক চুলার অনুমোদনের বিপরীতে পাঁচ সাতটি চুলা জ্বালানো এবং একাধিক পরিবারের রান্না করার ব্যাপারটি অনেকটা স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে যে, গতকাল সলিমপুরের জনৈক নুরুল্লাহর দোতলা বাড়িতে গ্যাসের প্রি পেইড মিটার লাগানোর প্রস্তাব নিয়ে গেলে বাড়ির মালিক মিটার লাগাতে অস্বীকৃতি জানান। তাকে নানাভাবে বুঝিয়েও রাজি করাতে ব্যর্থ হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাড়ির মালিক জানান যে, তাদের একটিই চুলা। তা দিয়ে তাদের সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলছে। মিটার লাগানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাড়ির লোকজন এবং চারপাশের পরিস্থিতি দেখে সন্দেহ হলে তারা রান্নাঘর দেখতে চান। পরবর্তীতে তল্লাশি করে ওই দোতলা বাড়িটির উপরে নিচে পাঁচটি ডাবল বার্ণার চুলা আবিস্কার করেন। উক্ত গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
প্রি পেইড মিটারে গ্যাস চুরি এবং অপচয়ের সুযোগ না থাকায় এই ধরণের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত গ্রাহকেরা কোনভাবেই প্রি মিটারের আওতায় আসতে চাচ্ছেন না। এতে কোটি কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় ও চুরি ছাড়াও পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের পথেও বড় ধরণের অন্তরায় হয়ে উঠেছে।
এছাড়া পাইপসহ জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অনেক গ্রাহক প্রি পেইড মিটার লাগানোর ক্ষেত্রে অনীহা দেখাচ্ছে। চলমান প্রকল্পের আওতায় গ্রাহকদের বাসাবাড়ির বিদ্যমান লাইনগুলো প্রি–পেইড মিটার স্থাপনের উপযোগী হলেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রাইজারের পাশেই প্রি–পেইড মিটার স্থাপন করে দেয়া হচ্ছে। এজন্য কোন ফি বা টাকা নেয়া হচ্ছে না। রাইজার থেকে রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত পাইপ লাইনে কোন লিক থাকলে সেখানে প্রি পেইড মিটার স্থাপন করা হচ্ছে না। অনেক বাড়িতে রাইজার থেকে একটি লাইন নিয়ে তা থেকে পুরো বিল্ডিং এর সবগুলো চুলাতে সাব লাইন দেয়া হয়ে থাকে। প্রি পেইড মিটার স্থাপনের আগে এই ধরণের লাইনগুলো সিঙ্গেল লাইন অর্থাৎ রাইজার থেকে একটি চুলা পর্যন্ত লাইন টেনে নিতে হবে। রাইজার থেকে একাধিক চুলার জন্য একটি লাইন টানা থাকলে সেখানেও প্রি পেইড মিটার স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না। রাইজার থেকে চুলা পর্যন্ত গ্রাহক নিজ খরচে লাইন ঠিকঠাক এবং আলাদা করে দেয়ার পরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রিপেইড মিটার লাগিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে এই লাইন আলাদা করার খরচ অনেক। পাইপসহ আনুষাঙ্গিক জিনিজপত্র এবং মিস্ত্রির মজুরি বৃদ্ধির কারণে বহু গ্রাহকই প্রি পেইড মিটারের ব্যাপারে আগ্রহ হারাচ্ছে। ভবনের উচ্চতা ভেদে এক একটি চুলার জন্য আলাদা লাইন করতে ৭/৮ হাজার টাকা থেকে ১৫/১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ছে। কোন গ্রাহককে দশটি চুলার লাইন আলাদা করতে হলে বেশ বড় অংকের একটি অর্থ যোগানোর ধকল সামলাতে হচ্ছে। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসা বাড়িতে গ্যাসের বিল ভাড়াটিয়া দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে গ্যাস সাশ্রয় হলে ভাড়াটিয়ার উপকার হবে, বাড়ি মালিকের বিশেষ কোন উপকারে আসবে না। তাই বাড়ি বা ভবনের মালিক প্রি পেইড মিটারের জন্য বাড়তি অর্থ খরচের ঝামেলায় যেতে চাচ্ছে না।
উপরোক্ত কারণে চট্টগ্রামে এক লাখ প্রি–পেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। গত চৌদ্দ মাসে মাত্র ৬৮ হাজার ৮শ’ গ্রাহককে প্রি–পেইড মিটারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ২৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ইতোপূর্বে স্থাপিত ৬০ হাজার প্রিপেইড মিটারের সুফল পাওয়ার দ্বিতীয় দফায় এক লাখ প্রি পেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন প্রকৌশলী গতকাল দৈনিক আজাদীকে জানান, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ৬ লাখের মতো আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এরমধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার প্রি পেইড মিটার স্থাপনের কাজ চললেও বাকি গ্রাহকেরা বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। যেখানে কোটি কোটি টাকার গ্যাস চুরি এবং অপচয় হচ্ছে। দেশের গ্যাস খাতের চুরি ও অপচয় ঠেকাতে প্রতিটি সংযোগের বিপরীতেই প্রি মিটার স্থাপন জরুরি বলেও ওই প্রকৌশলী মন্তব্য করেন।